ভূমিকা: প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনে ও এতে নিয়োজিত জনশক্তি ও উপায়-উপকরণের কার্যকর ব্যবহারে ব্যবস্থাপনা হলো অতি অপরিহার্য সামাজিক প্রক্রিয়া। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতির ভিন্নতার কারণে ব্যবস্থাপনার প্রকৃতিতে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেলেও সর্বত্রই ব্যবস্থাপনার কতিপয়সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে এরূপ প্রকৃতি বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো:
১. প্রক্রিয়া বা কাজের সমাহার: ব্যবস্থাপনা হলো কতিপয় ধারাবাহিক কর্ম সমষ্টি বা কর্ম প্রক্রিয়া। Stoner ও অন্যদের মতে, প্রক্রিয়া হলো কর্ম সম্পাদন বা কর্ম পরিচালনার প্রণালীবদ্ধ পদ্ধতিবিশেষ। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে লক্ষ্যার্জনের জন্য পরিকল্পনার থেকে শুরু করে সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ কার্যাদি পরস্পর সম্পর্ক রেখে ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করা হয়।
২. সামাজিক প্রক্রিয়া বা কার্যক্রম: ব্যবস্থাপনা একটি প্রক্রিয়া এবং সেই সঙ্গে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। কারণ ব্যবস্থাপনা প্রতিৃষ্ঠানের জনশক্তিকে সংঘবদ্ধ করে তাদেরকে সমাজবদ্ধ করে, পারস্পারিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে পরস্পর সহযোগী করে তোলে এবং প্রত্যেকের পৃথক কর্মপ্রয়াসকে সমন্বিত করে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য অর্জনের সক্ষম করে তোলে।
Chester I. Barnard সংগঠনকে সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরেছেন। এর এ ব্যবস্থাকে সংহত ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে ব্যবস্থাপনা।
৩. লক্ষ্যার্জনের উপায়: যে কোন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মূলে একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল থাকে। আর এ লক্ষ্যার্জনের জন্যই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ কারণেই বিভিন্ন লেখক ব্যবস্থাপনাকে লক্ষ্যার্জনের উপায় হিসেবে গন্য করেছেন।
হগেটস বলেছেন, ব্যবস্থাপনা হলো উদ্দেশ্য নির্ধারণ এবং কর্মীদের প্রচেষ্টাকে সমন্বিত করে তা অর্জনের একটি প্রক্রিয়া।
৪. কাজ আদায়ের কৌশল: প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত উপায়-উপকরণের কার্যকর ব্যবহারের প্রতি ব্যবস্থাপনা গুরুত্বারোপ করে। আর এজন্য ব্যবস্থাপনা সবসময়ই প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত জনশক্তির কাছ থেকে যথাযথ কাজ আদায়ে সচেষ্ট থাকে। ব্যবস্থাপনার সকল কর্ম প্রচেষ্টাই জনশক্তির কাছ থেকে কাজ আদায়ের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এ জন্যই L, Appley বলেছেন,
ব্যবস্থানা হলো অন্য লোকদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেয়া।
৫. দলীয় কর্ম প্রচেষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ততা: যে কোন দলীয় কর্মপ্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। ব্যক্তি যখন একলা কোন কিছু পাওয়ার জন্য প্রয়াস চালায় তখন ব্যবস্থাপনা বলে সেখানে কিছুই থাকে না। যখন এরূপ প্রচেষ্টায় অনেক লোক একত্রে কাজ করে তখন স্বাভাবিকভাবে সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে ও এর পরিচালনার জন্য ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। এভাবে দল, উপদলের সংখ্যা যতোই বাড়ে ব্যবস্থাপনা ততোই জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। Terry ও Franklin তাই বলেছেন, এটা সাধারণ যে ব্যবস্থাপনা দলীয় কার্যের সাথে সম্পৃক্ত।
৬. অর্থনৈনিক সম্পদ: ব্যবস্থাপনা একটি মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। সকল উপায়-উপকরণ কাম্য মানে থাকার পরেও ব্যবস্থাপনা সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে বা অদক্ষতার কারণে লক্ষ্যার্জন সম্ভব হয় না। অনুন্নত দেশসমূহে অপর্যাপ্ত পরিচিলনা ও ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা নির্ধারিত লক্ষ্যার্জনের প্রধান অন্তরায়।
Herbison ও Myers এর মতে,
ব্যবসায়ে নিয়োজিত শ্রমশক্তি, উপকরণ ও পুঁজির ন্যায় একটি অর্থনৈনিক সম্পদ হলো ব্যবস্থাপনা।
সীমিত সম্পদকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগিয়ে ব্যবস্থাপনা উদ্দেশ্যার্জনে মুখ্য শক্তির ভূমিকা পালন করে বিধায় Kreitner ব্যবস্থাপনাকে ফলিত অর্থনীতি হিসেবে গণ্য করছেন।
৭. কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব: ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের বিষয়টি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা যদি কর্তৃত্ব সম্পন্ন না হয় তবে তার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কর্তব্য সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগন যেমনি উচ্চ মাত্রায় কর্তৃত্ব ভোগ করেন তেমনি একেবারে নিচের পর্যায়ের কর্মরত ফোরম্যান বা সুপাবাইজারগণ সীমিত কর্তৃত্ব ভোগ করেন। যে পর্যায়ে গিয়ে কোন কর্মী কোন কর্তৃত্ব ভোগ করে না, সেক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত নয় ধরে নেয়া হয়। কর্তৃত্বের সঙ্গে দায়িত্ব সর্ম্পকযুক্ত। ব্যবস্থাপনার যে পর্যায়ে ব্যবস্থাপকগণ অধিক কর্তৃত্বশীল সেক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বও অত্যাধিক থাকে।
৮. সর্বজনীনতা: গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন অর্থাৎ দলবদ্ধ যে কোন প্রচেষ্টার ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। একটা পরিবার পরিচালনা পরিবার প্রধান পিতা বা মাতা যেমনি ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ও ব্যবস্থাপনার জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারেন তেমনি সমাজপতি, রাষ্ট্রপতি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সামাজিক প্রতিষ্ঠানেই পরিকল্পনা, উপকরণাদি সংহতকরণ, পরিচালনা বা নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কার্য অপরিহার্য বিবেচিত হয়। তাছাড়া ব্যবস্থাপনার নীতিমালা সকল দেশে সকল যুগেই প্রায় সমানভাবে প্রযোজ্য।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যবস্থাপনা জ্ঞানের পৃথক ও সমৃদ্ধ একটি শাখা হিসেবে আধুনিক সভ্যতায় তার স্থান করে নিয়েছে। সম্পুর্ণ পেশা হিসাবে তা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত না হলেও নানান প্রয়াস প্রচেষ্ঠার মাধ্যমে পৃথক পেশার মর্যাদার কাছাকাছি গিয়ে পৌছেছে। যে কোন প্রতিষ্ঠানেই ব্যবস্থাপনা কার্যের আবশ্যকতা এর লক্ষ্যার্জনে আজ এক অপরিহার্য বিষয়। ব্যবস্থাপনার সাফল্যের ওপরই বর্তমান যেকোন প্রতিষ্ঠানের সাফল্য ও অগ্রগতি নির্ভরশীল।
1 Comment
অনেক সুন্দর আলোচনা। ধন্যবাদ❤️