একুশে ফেব্রুয়ারি- শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ দিনটি বাঙালির জীবনে শোক, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। যার ফলশ্রুতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্র-জনতার বুকের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়। সেই রক্ত রঞ্জিত বাংলা ভাষা এখন বিশ্বজুরে ব্যাপৃত। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সেই ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পূর্তিতে আমাদের এ আয়োজন।
ভাষা আন্দোলন
১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। ফলে পূর্ব বাংলায় ১৯৪৭ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদ অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবে সংশোধনী এনে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান। ১৯ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ২১ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ) তিনি ঘোষণা দেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। ২৪ মার্চ তিনি কার্জন হলে পুনরায় একই কথা বলেন। জিন্নাহ’র এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১১ মার্চ ১৯৫০ ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ২৫ জানুয়ারি ১৯৫২ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় আসেন এবং ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় জিন্নাহ’র কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু। ফলস্বরূপ বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। ৩০ জানুয়ারি ১৯৫২ গঠিত ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ নুরুল আমীন সরকার আন্দোলনের ভয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে অন্দোলঙ্কারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার-বরকতসহ আরও অনেকে। একুশে ফেব্রুয়ারির এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
বাংলা ভাষা সাংবিধানিক স্বীকৃতি
১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে ১৯৫৪ অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর জাতীয় পরিষদের সদস্য ফরিদপুরের আদেল উদ্দিন আহমদে দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী জাতীয় পরিষদে ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়। ২৩ মার্চ ১৯৫৬ সংবিধান কার্যকরের মাধ্যমে তা সাংবিধানিক রূপ লাভ করে। সংবিধানের ২১৪(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বলা হয় The State Laanguage of Pakistan shall be Urdu & Bengali [পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং বাংলা]। এরপর ১ মার্চ ১৯৬২ পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধানেও জাতীয় ভাষা হিসেবে ‘বাংলা’ স্বীকৃতি পায়। সংবিধানের ২১৫(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বলা হয় পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে উর্দু ও বাংলা। ১৯৭২ সালে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংগ্রাম পরিষদ
নাম | গঠন | আহ্বায়ক |
---|---|---|
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ | ১ অক্টোবর ১৯৪৭ | নূরুল হক ভূঁইয়া |
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ (পুনর্গঠিত) | ২ মার্চ ১৯৪৮ | শামসুল আলম |
বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ | ১১ মার্চ ১৯৫০ | আবদুল মতিন |
সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ | ৩০ জানুয়ারি ১৯৫২ | কাজী গোলাম মাহবুব |
[সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র; প্রথম খণ্ড (পৃষ্ঠা ২৩০); একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন (পৃষ্ঠা ১৩৯) এবং জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫; লেখক- ভাষা সৈনিক অলি আহাদ (পৃষ্ঠা ১৩০)।]
বাংলা ভাষার বৈশ্বিক স্বীকৃতি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
৯ জানুয়ারি ১৯৯৮ কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানান। ২৩ জানুয়ারি ১৯৯৮ জাতিসংঘ থেকে উত্তর আসে যে জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, এ সংস্থা কোনো ব্যক্তির আবেদন বিবেচনায় নিতে পারে না। আবেদন আস্তে হবে জাতিসংঘের যেকোনো সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এ প্রেক্ষিতে রফিকুল ইসলাম কানাডা প্রবাসী আরেক বাংলাদেশি নাগরিক আবদুস সালামকে নিয়ে সাতটি ভিন্ন ভাষার ১০জন সদস্য মিলে The Mother Language Lovers of the World নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। ২৯ মার্চ ১৯৯৮ এ সংগঠনের পক্ষ থেকে আবার ১০ সদস্যার স্বাক্ষর সংবলিত সেই একই প্রস্তাব জাতিসংঘে পাঠানো হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের অফিস থেকে জানানো হয়, এটির জন্য যোগাযগ করতে হবে প্যারিসে অবস্থিত UNESCO’র সাথে। ৪ এপ্রিল ১৯৯৯ UNESCO ফ্যাক্সে পাঁচটি দেশের নাম এবং তাদের UNESCO অফিসের ঠিকানা দিয়ে ঐ সব দেশকে প্রস্তাবটি জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপনের অনুরোধ জানায়। দেশ পাঁচটি হচ্ছে- কানাডা, ভারত, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং বাংলাদেশ। অবশেষে ৫ অক্টোবর- ১৫ নভেম্বর ১৯৯৯ অনুষ্ঠিত UNESCO’র নির্বাহী পরিষদের ১৫৭তম অধিবেশনে প্রস্তাবটি স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর UNESCO’র দ্বি-বার্ষিক ৩০তম সাধারণ সভার শেষ দিন অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর ১৯৯৯ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়। সেদিনই প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। উপস্থিত ১৮৮টি সদস্য রাষ্ট্রের কেউই এ প্রস্তাবের বিরধিতা করেনি। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ
২৫ সেপ্টেম্বের ১৯৭৪ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এ ভাষণের মাধ্যমে প্রথম কোনো বিশ্ব সংস্থার আনুষ্ঠানিক সভায় বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়। ২৯ তম এ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম এশীয় নেতা, যিনি সবার আগে ভাষণ দেন।
তিন দেশের সরকারি ভাষা বাংলা
বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশসহ তিনটি দেশের সরকারি ভাষা বাংলা। অন্য দুটি দেশ হলো ভারত ও সিয়েরা লিওন। ভারতে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ভাষা রয়েছে ২২টি। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা। ভারতে রাজ্যগুল প্রয়োজনে হিন্দির পাশাপাশি নিজস্ব এক বা একাধিক দাপ্তরিক ভাষা গ্রহণ করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা বাংলাকে সেই মর্যাদা দিয়েছে। এছাড়া বাংলা আসাম এবং আন্দামান-নিকোবর রাজ্যের সহ-দাপ্তরিক ভাষা। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঝাড়খণ্ড রাজ্য বাংলাকে দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এ ছাড়া পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচি সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম স্বীকৃত দ্বিতীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা। বাংলা তৃতীয় যে দেশের ‘রাষ্ট্রীয় ভাষা’ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে, সেই সিয়েরা লিওনের সঙ্গে এ ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশস্থলের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কোনো যোগাযোগ নেই। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের অংশ হিসেবে দেশটিতে পাঁচ হাজারের বেশি বাংলাদেশি সৈন্য মোতায়েন ছিল। তারা সিয়েরা লিওনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর এ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১২ ডিসেম্বর ২০০২ সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট ড. আহমেদ তেজান কাব্বা বাংলা ভাষাকে সিয়েরা লিওনের সরকারি ভাষা (সম্মানসূচক) হিসেবে ঘোষণা দেন।
বাংলা ভাষায় ডোমেইন
ডোমেইন নেম সিস্টেম পরিচালনাকারী ও বরাদ্দকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা Internet Corporation for Assigned Names and Numbers (ICANN)। এর অধীনে সংস্থা Internet Assigned Numbers Authority (IANA)। ৫ অক্টোবর ২০১৬ IANA বাংলাদেশকে ডটবাংলা (.bangla) ডোমেইন ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। ডোমেইনটি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পায় সরকারি টেলিযোগাযোগ সেবাদান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (BTCL)। ইন্টারনেটে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করবে এ ডোমেইন। এর ফলে সারা পৃথিবীর বাংলাভাষী মানুষ ইন্টারনেটে নিজের ভাষাতেই বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে পারবে। ১ জানুয়ারি ২০১৭ থেকে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (BTCL) গ্রাহক পর্যায়ে ডট বাংলা ডোমেইন নিবন্ধন শুরু করে। বাংলাদেশে জন্য ICANN-এর স্বীকৃত ডোমেইন দুইটি ডট বিডি (.bd)
ডোমেইন কী?
ইন্টারন্যাশনালাইজড ডোমেইন নেম (IDN) একটি ইন্টারনেট ডোমেইন নেম সিস্টেম, যা ওয়েব ঠিকানা লিখতে প্রচলিত ইংরেজি ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা সমর্থন করে। কোনো একটি রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করে এ ডোমেইন।
বাংলা ভাষা প্রচলন আইন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ জাতীয় সংসদে পাস হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭। ৮ মার্চ ১৯৮৭ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ কার্যকর করা হয়। এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায়।