বাংলা ভাষায় অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে ভাবনা-প্লাবন সৃষ্টি হয়, তাতে প্রবলভাবে ইন্ধন জোগায় কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) এ কবিতা। তিনি কবিতাটি রচনা করেন আজ থেকে ১০০ বছর আগে।
বিদ্রোহীর প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের শেষদিকে সেনাবাহিনীতে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক হিসেবে যোগ দেন কাজী নজরুল ইসলাম। তার পোস্টিং হয় করাচি সেনানিবাসে। সেই সেনানিবাসেই তার কাব্যচর্চার সূচনা ঘটে। সৈনিক অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেখেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। গভীরভাবে উপলব্ধি করেন ঔপনিবেশিক শোষণ ষড়যন্ত্র। ১৯২১ সালের দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের অভিঘাতে বিশ্বব্যাপি অবক্ষয়, নৈরাজ্য, একাকিত্ব, ব্যক্তিগত জীবনের প্রণয় বিয়োগ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা তাকে তীব্রভাবে আলোড়িত করে। উত্তাল সেই সময়ে নজরুল রচনা করেন তার কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’।
রচনাকাল
কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। কবিতাটির প্রথম শ্রোতা ছিলেম মুজফফর আহমদ। কলকাতার ৩/৪সি তালতলা লেনের এর ভাড়া বাড়ির এক তলায় থাকতেন মুজফফর আহমদ ও নজরুল ইসলাম। কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন রাতে, এক টানে; সকালে তিনি মুজফফর আহমদকে পড়ে শোনান। প্রসঙ্গত মুজফফর আহমদ লিখেছেন,
‘আমার মনে হয় নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। তার ঘুম সাধারনত দেরিতেই ভাঙত, আমার মতো তাড়াতাড়ি তার ঘুম ভাঙত না। এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিল দিয়ে লিখেছিল।’
প্রকাশ
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুল প্রকাশের জন্য মোসলেম ভারত পত্রিকায় দিলেও তা প্রথমে ৬ জানুয়ারি ১৯২২ বিজলী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে এ বিষয়ে কৌতূহলোদ্দীপক তথ্যটি হলো, ছাপার তারিখের সাক্ষ্য মতে, ‘বিদ্রোহী’ প্রথমে মুদ্রিত হয় মোসলেম ভারত পত্রিকার কার্তিক ১৩২৮ (অক্টোবর-নভেম্বর ১৯২১) সংখায়। তারপর এটি প্রকাশিত হয় বিজলীতে ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে (৬ জানুয়ারি ১৯২২)। মোসলেম ভারত পত্রিকাটির প্রকাশ ছিল অনিয়মিত। কার্তিক সংখ্যাটি প্রকাশ হয় ফাল্গুন মাসে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯২২)। তার আগেই নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশ হয় বিজলী পত্রিকায়। মজার কথা, কবিতাটির প্রকাশ তথ্য হিসেবে বিজলীতে লেখা হলো যে ‘বিদ্রোহী’ মোসলেম ভারত থেকে পুনর্মুদ্রিত অথচ মোসলেম ভারত তখন প্রকাশই হয়নি।
নিষিদ্ধ না হওয়ার কারণ
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সুস্পষ্ট রাজদ্রোহের ঘোষণা থাকলেও সে সময়ের ইংরেজ সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ করতে পারেনি নানা কারণে। এ সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলেন, এ কবিতায় হিন্দু-মুসলমান দু’ধর্মের এত পুরাণ প্রসঙ্গ ঢুকেছে যে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি একে রাজদ্রোহ বলে চিহ্নিত করতে পারেনি। কখনো ঈশান-বিষানের ওঙ্কার বাজছে, কখনো বা ইস্রাফিলের শিঙ্গা থেকে উঠছে ঝঙ্কার। কখনো বা হাতে নিয়েছে মহাদেবের ডমরু-ত্রিশূল, কখনো বা অর্ফিয়াসের বাঁশি। কখনো বাসুকীর ফণা জাপ্টে ধরেছে। কখনো বা জিব্রাইলের আগুনের পাখা, কখনো চড়েছে তাজি বোরাকে (পক্ষীরাজ ঘোড়া) কখনো বা উচ্চৈঃশ্রবায়। একে রাজদ্রোহ বলতে গেলে ধর্মের উপরে হাত দেওয়া হবে।’ সরাসরি নিষিদ্ধ করতে না পারলেও প্রকাশিত কপি বাজেয়াপ্ত করা এবং পুড়িয়ে ফেলতো ইংরেজ সরকার।
শতবর্ষ উদযাপন
‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ উদযাপনে দেশে-বিদেশে গৃহীত হয় নানা কর্মসূচি। বাংলা একাডেমিতে কাজী নজরুল ইসলামের স্মারক ভাস্কর্য উদ্বোধন করা হয়। নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে এ কবিতার ওপর গত ১০০ বছরে প্রকাশিত প্রবন্ধ নিয়ে ‘বিদ্রোহী’ নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া ভারতের নজরুল সেন্টার অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ থেকে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ভারতীয় উপমহাদেশের ১০০টি ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি
- ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়- ১৯২২ সালে।
- ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যে কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত- অগ্নিবীনা।
- ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূলসুর- বিদ্রোহ ও বিপ্লবের আবেগ।
- কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়- সাপ্তাহিক ‘বিজলী’।
- ‘বিদ্রোহী কবি’ বলা হয়- কাজী নজরুল ইসলামকে।
- কাজী নজরুল ইসলাম সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দেন- ১৯১৭ সালে।