স্কুল জীবনের স্মৃতি
সূচনা
জীবন ও জগতের সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয় মনের দলগুলো ধীরে ধীরে মেলতে শুরু করেছে তখন থেকে। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে প্রকৃতির বিচিত্র দৃশ্যরূপ দেখতে শিখেছি তখন থেকে জীবনের আনন্দ অবাধ ও সহজ হয়ে উঠেছে তখন থেকেই। তাই সব ভোলা যায় স্কুলজীবনের স্মৃতি ভোলা যায় না সে বড় মধুর চিরস্মরণীয়।
জীবনের বৈশিষ্ট্য
জীবনের দিনগুলো কখনও এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে থাকে না। এগিয়ে যাওয়াই জীবনের বৈশিষ্ট্য। সেই কোন অতীতে একদিন দুরু দুরু বুকে প্রকৃতির বিচিত্র লীলানিকেতন নয়নপুর গ্রামের এক অখ্যাত বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলাম আজ তা স্মৃতি হয়ে মনের কোণে ভেসে আছে। তারপর আনন্দ বেদনায় মুখরিত কত শত দিন চলে গেছে। তবু মনে হয় বুঝি এই সেদিন বাড়ি থেকে স্কুলের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম।
স্মৃতি
আজ ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলোর দিকে তাকালে কত কথাই না মনে পড়ে। আবার মনের অতলে কত কথাই যে হারিয়ে গেছে তার কোন হিসেব নেই। জ্ঞানের রাজ্যে সেই প্রথম প্রবেশ এবং সেই পরিবেশের একটা নতুন আকর্ষণ ও আবেগের উন্মাদনা আছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে বৃহৎ ধারাপাত সচিত্র আদর্শলিপি ও বানান শিক্ষার সঙ্গে সদ্য কেনা শ্লেট নিয়ে আব্বার সঙ্গে স্কুলে। ভর্তি করে দিয়ে তিনি আমার শিক্ষককে বললেন ছেলের হাড়ডি ক খান আমাকে ফেরত দেবেন মানুষ করার জন্য মাংসটুকু আপনি রেখে দিতে পারেন। কথাটার তাৎপর্য তখন বুঝতে পারলে শিউরে উঠতাম হয়ত লেখাপড়ার সাধ সেখানেই মিটে যেত। প্রথম পাঠের স্মৃতি আমার এখনও মনে আছে। বাড়িতে কিছুদিন মার কাছে লেখাপড়া করেছিলাম, তাই স্কুল শুরু হল চল যাই লিচু খাই থেকে। ছবিতে লিচু দেখে জিভে পানি এসেছিল। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কত ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে চলল। কত রূপকথা দেশ বিদেশের ইতিকাহিনী গল্প শুনলাম শুনে শুনে অবাক হলাম পৃথিবী কত বড় কত লোক আছে। কত বিচিত্র এর দৃশ্যরূপ। ধীরে ধীরে মন যেন প্রকাশিত হতে চাইল।
আমাদের স্কুলের পেছনেই ছিল অনেকগুলো পেয়ারা গাছ। অবসর পেলেই তার একটাতে চড়ে চুপ কর বসে থাকতাম অদূরে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে সবুজ ফসল ঢেউ খেলে যেত। আর উপরে কি প্রশান্ত উদার নীল আকাশ। সবুজ প্রান্তর যেন মৌন আকাশের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করার জন্য দূরে বহুদূরে তার চরণপ্রান্তে অবনত হয়ে আছে। দুপুরের বিরতির সময় দল বেঁধে কেঊ গেছি বটতলায় গোল্লাছুট অথবা রুমালচোর খেলার জন্য কেউ বা রেললাইন থেকে পাথর কুড়িয়ে এনে তেঁতুল গাছে লক্ষ্যভেদ করেছি। কোনদিন ম্যাজিসিয়ান আসতো ম্যাজিক দেখাতে টিফিনের পয়সা সেদিন তার পেছনেই যেত। তার অলৌকিক ক্ষমতা আমাদের ঈর্ষার বস্তু ছিল। কত চেষ্টা করেছি তার মত হাত সাফাইয়ের পরিচয় দিতে। কখনও কখনও অন্য ক্লাসের ছুটি থাকলে তাদের কলকোলাহলে বটতলা মুখরিত হয়ে উঠত। তখন ক্লাস করতে আমাদের আর ভাল লাগত না। চার দেয়ালের মধ্যে বসে যেন হাঁপিয়ে উঠতাম। বইয়ের পাতা কিশোর মনকে আর বেঁধে রাখতে পারত না। মন পড়ে থাকত বটতলায় ইটবাধানো চত্বরে পেয়ারা গাছের ডালে। শুধু ভাবতাম সমস্বরে নামতা পড়ে দশ দশে একশো একথা কয়টা উচ্চারণ করে কখন ছুটব বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিতে। কতদিন স্কুল পালিয়ে খেলায় যোগ দিয়েছি। খেলা শেষে ক্লান্তদেহে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন কি প্রাণ প্রাচুর্য কি প্ৰগলভ উল্লাস।সবচেয়ে ভয়ানক দিন হত যেদিন স্কুলে শহর থেকে পরিদর্শক আসতেন। চার পাঁচ দিন আগে থেকে স্কুলঘর ও আশপাশের স্থানগুলো পরিষ্কার করার জন্য প্রধান শিক্ষক সাহেবের হাঁকডাক জামা কাপড় নখ চুল দাঁত ইত্যাদি পরিপাটি ও পরিষ্কার রাখার জন্য শিক্ষকদের অবিরাম উপদেশ চার পাঁচদিন ধরে একই পড়া পড়িয়ে সবাই মিলে দিনটাকে বিভীষিকাময় করে তুলতেন। তবে একটা আনন্দের ব্যাপারও জড়িত থাকত তার সঙ্গে। পরিদর্শক এলে তাঁর সৌজন্যে দুয়েকদিন ছুটি পাওয়া যেত। মাঝে মাঝে মন বিদ্রোহী হয়ে উঠত। ভাবতাম আর কখনও স্কুলে যাব না। তবু সহপাঠীদের সান্নিধ্য স্নেহমমতা দুয়েকজন হৃদয়বান শিক্ষকের আকর্ষণ এক অদৃশ্য শক্তির মত টেনে নিয়ে গেছে সেখানে। আবার শুরু হয়েছে গতানুগতিক জীবন।
স্কুলের কথা
স্মৃতিতে অস্পষ্ট হলেও আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে বৃহৎ ধারাপাত আদর্শলিপি ও বানান শিক্ষার সঙ্গে সদ্য কেনা শ্লেট নিয়ে আব্বার সঙ্গে স্কুলে গিয়েছি। ভর্তি করে দিয়ে স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত আব্বা বসে ছিলেন স্কুল লাইব্রেরিতে। ছুটি শেষে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে গেলেন। সে কি মধুর স্মৃতি তা কি কখনো ভুলা যায়? বাড়িতে প্রথম পাঠের স্মৃতি আমার এখনও মনে আছে। অ তে অজগর অজগরটি আসছে তেড়ে আমটি আমি খাব পেড়ে ইত্যাদি।
হাই স্কুলে ভর্তি
একদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি ছেড়ে আবার হিজলতলী হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। নতুন স্কুলে বৃহত্তর পরিবেশে এসে আমি যেন এক বড় জগৎ দেখতে পেলাম। শ্রেণীর বিন্যাসের প্রেক্ষিতে ছোট বড় শিক্ষার্থীর কলকাকলিতে মুখরিত শিক্ষাঙ্গন যেন আমাদের নিয়ে এসেছে বৃহত্তর পরিবেশে। এখানে শৃঙ্খলা নিয়মকানুন নিয়মিত ক্লাস ঘন ঘন পরীক্ষা সহপাঠ্যক্রম কার্যক্রম যেন এক নতুন জীবনের সন্ধান দিল। প্রথম প্রথম নতুন পরিবেশে অস্বস্তিকর মনে হয়েছিল। পরে এর কল্যাণকর দিক আমাকে অভিভূত করতে থাকে। পরিণতিতে আমার মনে হয়েছে বাড়ি থেকে স্কুলই আমার জন্য বেশি আনন্দের।
শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা
হাই স্কুল জীবনের শুরু থেকেই প্রত্যেক শিক্ষকের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা দেখাতে সমর্থ হয়েছিলাম। এ দুটি গুণের জন্য বিদ্যালয়ের মধ্যে অচিরেই আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেক শিক্ষকের স্নেহ ও সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টির কথা আজও আমার মনে পড়ে। আমার স্কুল জীবন যে কত সুখের কত গৌরবের ছিল তা আজ স্কুল ছেড়ে এসে বুঝতে পারছি।
স্কুলের পরিবেশ ও লেখাপড়ার স্বাধীনতা
আমাদের বিদ্যালয়টি ছিল অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা। একটা মুক্ত ও প্রকৃতির আনন্দময় পরিবেশে আমরা লেখাপড়া করতে পেরেছি। লম্বা স্কুল ভবন, বিশাল মাঠ মাঠের পাশ দিয়ে বাঁধানো সড়ক চলে গেছে শহরের দিকে। একটা উন্মুক্ত পরিবেশ আমাদের সব সময় উৎফুল্ল করে রাখত। আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকগণ যে যত্নশীলতায় পাঠ দিতেন তা ছিল আমাদের জন্য পরমানন্দের। শিক্ষকগণ সংখ্যায় ছিলেন অনেক। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক হিসেবে তাঁরা আমাদের প্রত্যেকের নাম জানতেন এবং ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। এখানে যেন একটি বৃহৎ পরিবার জীবন গঠনে নিয়োজিত। পাঁচ বছর এখানে আমার অতিবাহিত হয়েছে। শিক্ষকদের তেমন পরিবর্তন ঘটেনি ছাত্রদেরও না। তবে বছরের শেষে ব্যর্থতার জন্য যারা বিদায় নিয়ে গেছে তারা আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষককে আমরা খুবিই ভয় করতাম। তাঁর কক্ষের কাছাকাছি যেতে আমাদের সাহস হত না। শ্রেণী শিক্ষকরা ছিলেন খুব যত্নশীল। প্রত্যেকটি বিষয় তাঁরা এমন মনোযোগ দিয়ে পড়াতেন যে ক্লাসের পর আমাদের কোন কোচিং সেন্টারে ছুটতে হত না। কারও বুঝতে অসুবিধে হলে অনেক সময় শিক্ষকগণ পৃথকভাবে পড়াবার ব্যবস্থা করাতেন। গৃহশিক্ষকতার বাহুল্য অত্যাচার থেকে আমরা ছিলাম মুক্ত। বাড়িতেও আমার কোন বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। স্কুলের কাজগুলো শেষ করাই আমার একমাত্র কর্তব্য ছিল। এতে আমি প্রচুর আনন্দ পেতাম।
মেলামেশায় স্বাধীনতা
আমার স্কুল জীবনে গৃহে যতটুকু স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। তাতে আমার যথেষ্ট উপকার হয়েছে। আজাকাল আমরা ঘরে বাইরে তাড়া খেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি। ষষ্ঠ শ্রেণী হতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত আমি ঐ একই স্কুলে পড়েছি। এ পাঁচ বছরের মধ্যে আমি অনেকের সাথে মিশেছি। বাঙালি অবাঙালি বহু ছাত্রের সাথে প্রাণ খুলে কথাও বলেছি। তাদের চালচলন রীতিনীতি ও মনোভাব শিক্ষা করেছি। আমার ঐ স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতাই আমাকে উন্নতির পথে এগিয়ে দিয়েছে। তখন ইচ্ছা ছিল প্রবৃত্তি ছিল। অনুসন্ধিৎসু ও জিজ্ঞাসু মনে যখন যা উদিত হয়েছে তাই জেনেছি তার ফলে আজ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের সাথে মিশতে অসুবিধা বোধ করি না।
পুরস্কার বিতরণী
স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী উৎসবের উদ্যোগ আয়োজনে আমরা যোগ দিয়েছি পরম উৎসাহে। আবৃত্তি অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেছি। সেদিনটা কাটত আনন্দ কোলাহলে আমোদ কৌতুকে। গ্রীষ্মের ছুটি ঘোষণার দিন স্কুল বসত সকালে। রাত থাকতেই সেদিন আমাদের ভীড় জমত বকুল তলায়। ক্লাসের প্রত্যেকের উপর ভার থাকত দুচারটা মালা প্রচুর ফুল ও সুদৃশ্য পাতা নিয়ে আসার। রকমারি ফুলের জলসা বসত সেদিন স্কুলে। প্রতি ক্লাসে প্রতিযোগিতা চলত কারা নিজেদের শ্রেণী সবচেয়ে সুন্দর করে সাজিয়েছে কাদের শিক্ষকের মাথা মালার নিচে ডুবে গেছে। প্রধান শিক্ষক যখন ক্লাসে আসতেন ফুলের মালা দিয়ে আমরা তাঁকে বরণ করতাম। সে কি উল্লাস সে কি আনন্দ সে কি উচ্ছল প্রাণবন্যা।
বিদায়ের স্মৃতি
যেদিন শেষ পরীক্ষা দিয়ে স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম মনটা ভারি হয়ে উঠল। মনে হল জীবনের এক অধ্যায় সমাপ্ত করে দ্বিতীয় অধ্যায়ে পা দিতে চলেছি কিন্তু স্কুল জীবনের স্মৃতি সারাজীবন আনন্দের উৎস হয়ে থাকে। জীবনের বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র সামনে পড়ে আছে। কত না বিচিত্র অভিজ্ঞতা জীবনে এসে ভীড় করবে। কিন্তু নয়নপুর বিদ্যালয়ের সেই স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলো কখনও ভুলবার নয়। রহমান স্যারের দরাজ গলায় কবিতা আবৃত্তি এখনও কানে লাগে। মনে পড়ে আজো বি এস সি স্যার অঙ্কটাকে কত সহজ করে তুলতেন। আর প্রধান শিক্ষকের লাল চোখ দুটোর আড়ালে কত স্নেহই না সঞ্চিত ছিল।
উপসংহার
এখনও যখন শূন্য মনে বসে থাকি মনের পর্দায় একের পর এক নতুন দৃশ্যপট ভেসে ওঠে সেই বটগাছ সেই পেয়ারা ঝোঁপ তেঁতুলগাছ সহপাঠীদের সুন্দর মুখ শিক্ষকদের স্নেহ মমতা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে সবুজের ঢল দূরে বহুদূরে আকাশ আর মাটিতে কানাকানি। আনমনে কবিতা আবৃত্তি করি-
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর পাঠশালা পলায়ন
ভাবিলাম হায় আর কি কভু ফিরে পাবো সে জীবন।