বাংলার উৎসব
ভূমিকা
উৎসব হলো আনন্দময় অনুষ্ঠান।আর আমরা বাঙালিরা উৎসব প্রিয়।উৎসবের মধ্যেই রয়েছে বাঙালির আনন্দ। তাই বাঙালির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের মেঘ বার বার ঘনিয়ে এলেও বাঙালির আনন্দস্রোতে ভাটা কখনো পড়েনি। বাঙালি নানান রঙে বার বার সাজিয়েছে তার উৎসবের ডালি।উৎসবের দিনের আনন্দের মুহূর্ত গুলোকে বাঙালি ছড়িয়ে রেখেছে তার বিস্তৃত জীবনের আঙিনায়।
কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ
বাঙালি ঘরকুনে এ অপবাদ আমাদের সকলেরই জানা কিন্তু তাই বলে বাঙালি কখনই আত্মকেন্দ্রিক নয়। আত্মকেন্দ্রিক মানে আপনাতে আপনি বদ্ধ।কিন্তু বাঙালি যদি আপনাতে আপনি বদ্ধ হতো তাহলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ হতনা। আমার আনন্দে সকলের আনন্দ হোক আমার আনন্দ আরো পাঁচ জন উপভোগ করুক এই কল্যাণী ইচ্ছাই হলো উৎসবের প্রাণ।সকল বাঙালির মনে এই ইচ্ছে আছে বলেই সবাই মিলেমিশে উৎসবে মেতে উঠে ।
উৎসবের শ্রেণীকরণ
বাংলার উৎসব গুলিকে মূলত চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা :
- (i) ধর্মীয় উৎসব
- (ii) সামাজিক উৎসব
- (iii) ঋতু উৎসব
- (iv) জাতীয় উৎসব
তবে উৎসবকে সুনির্দষ্টভাবে ভাবে বিভাজন করা যায় না ।যেমন কিছু উৎসব ঋতু বিষয়ক উৎসব বলে গণ্য কিন্তু ভালো করে বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে তার মূলে ধর্ম নিহিত রয়েছে ।
ধর্মীয় উৎসব
ধর্মীয় উৎসব গুলি বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভাবনাকে কেন্দ্র করে।হিন্দু মুসমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ শিখ প্রতিটি ধর্মের নানান রকমের উৎসব।সারা বছর ধরে একই ভাবে বাঙালির উৎসবের আমেজ।হিন্দু ধর্মের নানান রকমের পুজো পার্বণের উৎসব। যাদের মধ্যে অন্যতম দুর্গোৎসব। এই দুর্গোৎসব ই হলো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। শরৎ কাল এলেই বাংলার বুকে বেজে ওঠে ঢাকের বাদ্যি।
সামাজিক উৎসব
সামাজিক উৎসবেও একই ভাবে মেতে ওঠে বাঙালি। উপনয়ন অন্নপ্রাশন বাড়ি প্রতিষ্ঠা থেকে বিয়ে বাড়ি এসবই পড়ে সামাজিক উৎসবের মধ্যে।ভাই ফোঁটা জামাইষষ্ঠী এর মতো স্বজন উৎসব গুলিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।এই সমস্ত উৎসব অনুষ্ঠানের সমাজের এতো গভীরে নিবদ্ধ যে সমাজের আরো পাঁচজনকে না নিলে এসব উৎসব অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয়না।তাই সকল উৎসবে বাঙালি সবাই মিলে একই ভাবে আনন্দে মেতে ওঠে।
ঋতু উৎসব
বছরের ছয়টি ঋতুকে কেন্দ্র করে বাঙালির অসংখ্য উৎসব।নাচ গান সহ নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় শারদোৎসব বসন্তোৎসব এমনকি বর্ষা বন্দনা। চাষবাসের সাথে যুক্ত কৃষির উৎসব গুলি ঋতু উৎসবের এক একটি অঙ্গ। এছাড়াও ঋতু উৎসবে উল্লেখযোগ্য বসন্তে হোলি পৌষে মকর আঘ্রানে নবান্ন ইত্যাদি।
জাতীয় উৎসব
সর্বভারতীয় জাতীয় উৎসব গুলিতেও বাংলার বাঙালির আনন্দের ঘাটতি থাকেনা। শহর থেকে গ্রাম সারা সারা বাংলা মেতে ওঠে জাতীয় উৎসব গুলিতে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পতাকা উত্তোলন করা হয় ১৫ ই আগস্ট।২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস ও সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য -রবীন্দ্র জয়ন্তী,নেতাজির জন্মদিন গান্ধী জয়ন্তী বিবেকানন্দের জন্মদিন ইত্যাদি।
উৎসবের মধ্য দিয়েই মিলন
ব্যাক্তিগত দুঃখ কষ্ট ভুলে সবার সাথে আনন্দে মেতে ওঠায় উৎসবের প্রধান উদ্দেশ্য।উৎসবানুষ্ঠান নিবার্ধ মেলামেশার সুযোগ করে দেয় আমাদের। উৎসবের ময়দানে জাতি ধর্ম অর্থ গত ভেদাভেদের কোনো কোনো প্রাচীর থাকেনা। পারস্পরিক আনন্দ প্রীতি বিনিময়ের মধ্য দিয়েই রচিত হয় সুন্দর সুন্দর বন্ধুত্ব। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের এই আনন্দে মেতে ওঠা বাঙালির উৎসব পালনকে করে তোলে সার্থক।
উৎসবের উদ্দেশ্য
বাঙালির উৎসবের উদ্দেশ্য হলো প্রীতি ও প্রেমের পূর্ণ বন্ধন।মানুষের সঙ্গে মানুষের আনন্দময় আত্মিক মিলন।দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামে অবসন্ন মানুষের প্রাণশক্তি যখন শুকিয়ে আসে যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে জীবনের খণ্ড খণ্ড করি দণ্ডে দণ্ডে ক্ষয় তখন উৎসবের আয়োজন মনে আনে ফূর্তি আনে মুক্তি জীবনের আনন্দ সৃষ্টি করে নতুন কর্মপ্রেরণা।
উৎসবের উপযোগিতা
উৎসব কেবল মানব সম্মিলনের আনন্দ দেয় না প্রাণের স্ফূরণ ঘটিয়ে শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে সতেজ রাখে দেয় নব নব কর্মপ্রেরণা। উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষের সৃজনশীলতারও নানা প্রকাশ ঘটে। রচিত হয় সংগীত নৃত্য চিত্রকলা স্থাপত্য ভাস্কর্য চলচ্চিত্রের কত না সম্ভার। উৎসবের অর্থনৈতিক উপযোগিতাও কম নয়। উৎসবকে কেন্দ্র করে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক তৎপরতা চলে তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনেক পেশার মানুষ উপকৃত হয়।
উৎসবের বিবর্তন
বৈদিক ঋষিদের সোমরস নিষ্কাশনের এক আনন্দ উদ্বেল লোকাচার ছিল উৎসব। অন্য দিকে আদিম মানুষও শিকারের শেষে নির্দিষ্ট বাসস্থানে ফিরে এসে দলবন্ধ হয়ে আগুন জ্বালিয়ে উৎসবের আনন্দে মেতে উঠতো। তারপর সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষ উৎসবের ক্ষেত্রে আরো বেশি আন্তরিক হয়ে উঠছে। মানুষ উৎসবকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিয়েছে। তবে আগে উৎসবের মধ্যে একটা আলাদা মাহাত্ম্য ছিল। কারণ আগে উৎসবের সঙ্গে কল্যাণবোধ ও মঙ্গলবোধ জড়িত ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে মানুষ বড্ড বেশি যান্ত্রিক ও কৃত্রিম। সমাজে মানুষের প্রাচুর্যতার মধ্যেকার সত্তাকে করেছে বিনষ্ট। দুর্নীতি অবক্ষয় মূল্যবোধহীনতা মানুষের সম্পর্কের মধ্যে দেওয়াল তৈরি করেছে। আড়ম্বর ও অহংকারের মধ্যে বিলুপ্ত হতে বসেছে উৎসবের গুরুত্ব। এখন যেটুকু আছে তা লোক দেখানো। উৎসব এখন বিপণনে পরিণত হয়েছে।
বাঙালির উৎসবপ্রিয়তা
বাঙালির উৎসবের প্রেরণা মজ্জাগত। অবশ্য সমাজবিজ্ঞানীরা উৎসবের মৌল প্রেরণা সম্বন্ধে কয়েকটি দিকের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি– (১) ক্লান্তিকর একঘেয়েমির হাত থেকে মুক্তির পথ খোঁজা। (২) পরস্পর মিলনাকাঙ্ক্ষা। (৩) ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করা। (৪) প্রাণের আনন্দ আস্বাদনের ইচ্ছা। (৫) কর্মময় জীবনের সাফল্যের স্বীকৃতি। যেমন আদিম মানুষ শিকার সেরে এসে উৎসবে নিজেদের মুখরিত করতো। এখনো কোনো কোনো উপজাতির মধ্যে দেখা যায় উৎসবের সময় তারা পশুবলি দিয়ে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়। কৃষিজীবনেও ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নবান্ন পৌষ পার্বণের উৎসব। সুতরাং সর্বজনীন কল্যাণময় ইচ্ছা ই উৎসবের মূল প্রেরণা।
প্রাচীন বাংলার উৎসব মুহূর্ত
প্রাচীন বাংলার উৎসবের মধ্যে ছিল না। প্রাণের সঙ্গে প্রাণের অন্তরের সঙ্গে অন্তরের আত্মিক আদানপ্রদানে প্রাচীন বাংলা ছিল সমৃদ্ধ। প্রত্যেকে এই উৎসব তাদের সকলের উৎসব বলে মনে করত। বর্তমান ব্যতিব্যস্ততার দিনে প্রাচীনকালের সেই সদাচার ভক্তি বিশেষ পরিলক্ষিত হয় না। তবুও প্রাচীনকালের এই চর্চার ওপর নির্ভর করে বাঙালির জীবনযাত্রার গূঢ় তাৎপর্য আভাসিত হয়।
উৎসব সামাজিক মানুষের কর্তব্য
বাংলার উৎসব যেহেতু বাঙালির আপন হৃদয়ে মাধুরী দিয়ে গড়া তাই যে কোনো উৎসবে বাঙালিকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সৌভ্রাতৃবোধ ও আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে আনন্দময় জগৎ। সকল দ্বেষ মনের সকল অন্ধকার দূর করে দিয়ে একে অপরের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা করবে গড়বে নতুন ভালোবাসার জগৎ।
উপসংহার
প্রতিদিনের গতানুগতিক জীবন থেকে মুক্তি পেতে কে না চায়, সকলেই চায় বৈচিত্রের স্বাদ। সকলেই চায় নিজের গণ্ডিবদ্ধ জীবনকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে মুক্তি দিয়ে অসংখ্য প্রাণের স্পর্শে সরস ও মাধূর্যমন্ডিত করতে।তাই জীবনে উৎসবের প্রয়োজন অপরিসীম।তাই বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ অনুষ্ঠিত হবে। জিবনপ্রবাহের সাথে উৎসব অনুষ্ঠানের ধারাও সমান্তরাল ভাবে বয়ে চলবে অনন্তকাল।