কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা
কর্মশালার প্রবেশের দ্বার অতিক্ষুদ্র রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারের ন্যায় ইহা অভ্রভেদী নহে কিন্তু গৌরবের বিষয় এই যে এখানে নিজের শক্তি সম্বল করিয়া প্রবেশ করিতে হয় ভিক্ষাপাত্র লইয়া নহে।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা
শিক্ষা মানুষের মধ্যে মুক্ত মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে তাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আবার উপযুক্ত শিক্ষাই কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলে এবং তার ক্রমোন্নতির অপরিহার্য সহায়ক হয়ে ওঠে। কোনো ব্যক্তির নিজস্ব প্রকাতা তার অন্তর্নিহিত গুণাবলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যদি তাকে উপযুক্ত শিক্ষা না দেওয়া হয় তবে সে রাষ্ট্রগঠনের সহায়ক না হয়ে রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে পড়ে। প্রত্যেকের জন্য একই ধরনের শিক্ষা তাই কখনো উপযুক্ত হতে পারে না। সমাজের চাহিদা এবং ব্যক্তির ক্ষমতা মিলে শিক্ষাকে বহুমুখী করে তুলতে হবে। সে রকম শিক্ষাই হলো কর্মমুখী শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা। আধুনিক সমাজব্যবস্থার প্রকৃতি অনুসারে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি যে শিক্ষা যদি আত্মপ্রতিষ্ঠার সহায়ক না হয় তবে সেই শিক্ষা নিরর্থক। তাই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জীবন যুদ্ধের পাথেয় যোগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। এ জন্য আমাদের দেশে ব্যাপক হারে কর্মমুখী শিক্ষা প্রবর্তন করা প্রয়োজন।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
শিক্ষাকে কেবল আত্মিক উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সামাজিক প্রয়োজনের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। কারণ পরবর্তীকালে কৃষি বয়ন মৃৎশিল্প ধাতুশিল্প প্রভৃতি অপরিহার্য সামাজিক প্রয়োজনগুলো মেটানোর ভার অর্পিত হয় বংশানুক্রমে ঐ কাজগুলোর জন্য নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর। তাই প্রাচীনকালে গুণানুযায়ী কর্মবিভাগের ব্যবস্থা নির্দিষ্ট হয়েছিল। ফলে সমাজের মধ্যে কর্মভিত্তিক বিন্যাস ঘটে এবং পুরুষানুক্রমে একই উৎপাদনে নিযুক্ত থাকার কারণে উৎপাদিত বস্তুর গুণ বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। প্রাচীন গ্রামীণ সমাজে এভাবে কর্মমুখী শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রচলিত ছিল। প্রধানত লোকজ শিল্পীদের দ্বারা মাটি ধাতু কাঠ চর্ম শংখ সুতা ইত্যাদির ব্যবহার প্রধানত সমগ্র সমাজের প্রয়োজন মেটাতো।বর্তমান বিশ্বে কর্মের যে মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে আমাদেরকেও অংশগ্রহণ করতে হবে। কৃষিকাজ কামারের কাজ কুমারের কাজ ঘুতোরের কাজ চামড়ার কাজ বাঁশ ও বেতের কাজ প্লাস্টিকের কাজ তাঁতের কাজ ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ রেডিও টেলিভিশন মেরামতের কাজ ছাড়াও আরও অনেক বৃত্তিমূলক কাজ রয়েছে। এসব কাজ শারীরিক যোগ্যতা থাকার পরও যদি আমরা করতে কুণ্ঠিত হই তা হলে আমাদের শিক্ষাই যে কেবল নিরর্থক হবে তা নয় আমাদের দারিদ্র্য কোনো কালেই ঘুচবে না। তাই কর্মমুখী শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যাতে এদিকে এগিয়ে আসে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে দেশ জোড়া যে বেকার সমস্যা বিরাজমান তাও অনেকাংশে কমে আসবে। দেশ এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। যুগের সাথে সাথে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। যদিও শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে স্যাডলার কমিশন কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন কাজী জাফর বাতেন কমিশন এবং মজিদ খানের শিক্ষানীতি ইত্যাদি কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যথার্থ শিক্ষিত বানাতে অসমর্থ কেরানি তৈরি করে মাত্র। তাই এ অবৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভ করলেও মানুষের মতো মানুষ হওয়া যায় না। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে শুধু ডিগ্রি দেয় কিন্তু চাকরি বা কাজ দেয় না। তাই বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে হতাশাগ্রস্ত তরুণ যুবসমাজ আজ দিশেহারা। তারা আজ অন্যের হাতের ক্রীড়নক। বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত যুবসমাজ আজ অভিশপ্ত জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা
বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় যে তাদের পরিকল্পিত এবং কর্মমুখী বাবুস্তিমূলক শিক্ষার বাস্তব কর্মকাণ্ড। উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় কেরানি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আছে বিজ্ঞানী হওয়ার এবং কর্মের মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার। ব্রিটেন আমেরিকা জাপান ফ্রান্স জার্মানি সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ উৎপাদনমুখী বা কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষা চালু করে তারা আজ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে।
কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব
যে শিক্ষা অর্জন করে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায় এবং যার মাধ্যমে সহজে জীবিকা নির্বাহ করা যায় তাই হলো কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা। কর্মমুখী শিক্ষা লাভ করলে পরমুখাপেক্ষী হতে হয় না বেকার থাকতে হয় না বরং এ ধরনের শিক্ষা কর্মপ্রেরণা যোগায় এবং নিজের অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে দেশ ও জনগণের সেবা করা যায়। একথা ঠিক যে অদক্ষ শ্রমিক ক্রমে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে কিন্তু উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা পেলে তারা রাষ্ট্রের এবং সমাজের অধিকতর প্রয়োজন সুসম্পন্ন করতে পারে। এ জন্যই সকল প্রকার বৃত্তি গ্রহণের জন্যে উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করা দরকার।
আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার সম্ভাবনা
কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে আমাদের দেশে। কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণে কৃষিকাজ কলকারখানায় কাজ পেতে সুবিধা হয় এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয় তবে তা দেশের জন্য সুদূরপ্রসারী কল্যাণকর ফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে। ফলে দেশে বেকারের সংখ্যা কমবে এবং সুদক্ষ কর্মী বা কারিগরের সৃষ্টি হবে যারা নিজেদের দক্ষতায় ভাগ্যকে গড়ে নিতে পারবে। কাজেই আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার সম্ভাবনাসমূহ যাচাই করে যদি সুষ্ঠু পরিকল্পনাভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নেয় তবে ব্যাপক সাড়া জাগাতে পারবে বলে আশা করা যায়।উচ্চতর প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা অর্থাৎ ভাষা গণিত সমাজ ও সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষা প্রচলিত থাকবে এবং তারপর উপযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা উচ্চতর শিক্ষার উপযুক্ত ছাত্রদের বাছাই করে নিতে হবে। অবশিষ্টরা নিজ নিজ প্রবণতা ও অন্তর্নিহিত গুণানুযায়ী বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষায় নিযুক্ত হবে। এভাবে মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শেষেও বাছাই এবং অবশিষ্টদের গুণ ও প্রয়োজন অনুসারে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী এভাবে সকল ক্ষেত্রের উপযুক্ত দক্ষ কর্মী পাওয়া যাবে। এতে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করতে পারে।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা কী
বৃত্তি কথাটির অর্থ হলাে জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্ম বা পেশা । আমাদের দেশে বৃত্তিমূলক শিক্ষা বলতে সাধারণ কারিগরি শিক্ষাকেই বােঝায়। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং গাড়ি মেরামত ড্রাইভিং দর্জি বিদ্যা কাঠমিস্ত্রির শিক্ষা বই বাঁধাই টাইপ রাইটিং ও শর্টহ্যান্ড শিক্ষা ইত্যাদি শিক্ষা বৃত্তিমূলক শিক্ষার মধ্যে পড়ে। এ বিষয়ে পাঠগ্রহণের জন্য একজন ছাত্রকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবার প্রয়ােজন পড়ে না। নবম দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া যে কেউ বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে খুব সহজেই গ্রহণ করতে পারে। এ শিক্ষাগ্রহণে ব্যক্তি যেমন কর্মমুখী হতে পারে তেমনি দেশও লাভবান হবার সুযােগ থাকে। আধুনিক চেতনা থেকে মনে করা হয় যে শিক্ষা যদি আত্মপ্রতিষ্ঠার সহায়ক না হয় তাহলে সে শিক্ষা নিরর্থক। সে দিক থেকে বিচার করতে গেলে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকেই সর্বাগ্রে মূল্যায়ন করতে হয়।
উদ্দেশ্যহীন শিক্ষা
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা নয়। ব্যতিক্রম হিসেবে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা নামে একটি শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের দেশে আছে যা দেশের সামগ্রিক শিক্ষা চিত্র নয়। বৃত্তিমূলক শিক্ষাগ্রহণ না করার কারণেই যে শিক্ষক হলে ভালাে হতাে সে হয়ত হয়েছে সৈনিক যার ডাক্তার হবার কথা সে হয়ত হয়ে ওঠে আইন ব্যবসায়ী। উদ্দেশ্যহীন শিক্ষাগ্রহণ করে প্রথমে কেবল সার্টিফিকেট সংগ্রহের কাজ চলে তারপর যে যেমনটি জোটাতে পারল সেটিই তার বৃত্তি বা পেশা। ফলে জাতি দক্ষ পেশাজীবী জনবল পাচ্ছে না। অথচ মানুষ যদি তার ইচ্ছেমতাে বা যােগ্যতা মতাে বৃত্তি গ্রহণ করতে পারত তাহলে দেশ হতে দক্ষ কর্মজীবীতে ভরপুর। আর আমাদের পক্ষে সম্ভব হতাে কল্যাণকামী দেশ পাওয়া ।।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি
আমাদের দেশ বিভিন্ন দিক থেকে অনগ্রসর এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কর্মমুখী শিক্ষাকে আমাদের দেশে কোনোরকম গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ শিক্ষাকে তুচ্ছ বলে মনে করা হয়। সাধারণত অভিজাত শ্রেণি বা উচ্চ শ্রেণির অনেকে এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরাও এ শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় না। এ ধরনের মানসিকতা আমাদের সমাজ থেকে দূর করে কর্মমুখী শিক্ষায় মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার চেয়ে বৃত্তিমূলক কর্মমুখী শিক্ষা যে বেশি উপকারী এই চেতনা সৃষ্টি করতে না পারলে আমাদের ব্যক্তি বা জাতীয় জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব নয় । রেডিও টেলিভিশন পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে মানুষের মধ্যে এই চেতনাবোধ সৃষ্টি করতে হবে।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা কী
সাধারণ শিক্ষার সাথে বৃত্তিমূলক শিক্ষার একটি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান । এ শিক্ষায় মানুষকে একটি বিশেষ বিষয়ের ওপর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় প্রকার জ্ঞানদান করা হয় । শিক্ষা সমাপনান্তে একজন শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট বিষয়েই দক্ষতানুযায়ী কাজ বেছে নিতে পারে এবং পেশাগত জীবনে শিক্ষাকে প্রয়ােগ করতে পারে । কৃষি শিল্প চিকিৎসা বা কারিগরি ক্ষেত্রে জ্ঞানলাভের পর অর্জিত জ্ঞান জীবিকার প্রয়ােজনে কাজে লাগিয়ে একজন মানুষ যদি জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে । বর্তমানে কর্মমুখী শিক্ষার জনপ্রিয়তা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
প্রচলিত শিক্ষার ত্রুটি
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামাে তৈরি হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের হাতে । তারা নিজেদের স্বার্থে কিছু কেরানি সৃষ্টির মানসিকতায় এদেশের শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছিল । আমাদের দেশে এখনাে সেই শিক্ষাব্যবস্থাই চালু রয়েছে । ফলে শিক্ষার সাথে জীবন এবং কর্মযােগ না থাকায় এদেশে তথাকথিত সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের হার বাড়লেও দক্ষ কর্মী সৃষ্টি হয় নি । অধুনা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটলেও কারিগরি জ্ঞান ও প্রায়ােগিক শিক্ষার অভাবে এদেশের বিজ্ঞান শিক্ষাও অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে । সেজন্যই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়েও অনেকে বেকারত্ব ভােগ করছে কিংবা প্রশাসনিক পদে চাকরি করছে । প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার এই আত্মঘাতী ত্রুটির কারণেই আজ কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়ােজন তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে ।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রকারভেদ
বৃত্তিমূলক শিক্ষা দু প্রকারের- ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য বিজ্ঞানসহ উচ্চশিক্ষা প্রয়ােজন হয় কিন্তু অপরটি সাধারণ বৃত্তিমূলক শিক্ষা । এর জন্য কোন উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন হয় না । প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষালাভ করে এসব বৃত্তিমূলক শিক্ষা লাভ করা যেতে পারে । কলকারখানার কারিগর মােটরগাড়ী চালনাকারী পােশাক প্রস্তুতকারী কলকব্জার মেরামতকারী ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির মিস্ত্রী দুতার মিস্ত্রী স্বর্ণকার কর্মকার রচর্মকার রাজমিস্ত্রী চিত্রকর গায়ক অভিনেতা মৎস্যচাষী ইত্যাদি হওয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষার প্রয়ােজন নেই । এসব বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষালাভ করলেই জীবিকা অর্জনে সক্ষম হওয়া যায় ।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রটি
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেবলমাত্র পুঁথিগত বিদ্যায় সীমাবদ্ধ । আমাদের কর্মজীবনের সাথে এ শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই । তাই বিদ্যালয়সমূহ হতে পাশ করার পর আমাদের দেশের যুবকদের বেকার জীবন অতিবাহিত করতে হয় । সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের অফিসের কেরানীগিরি করা ছাড়া আর কিছু করার সামর্থ্য থাকে না । সুপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার অভাবে আমরা আজ সকল ক্ষেত্রে পশ্চাতে পড়ে রয়েছি।উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবভিত্তিক তাই সে দেশের ছেলে মেয়েরা শিক্ষাশেষে যে কোন কাজ যােগ্যতার সাথে করতে পারে । কিন্তু আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা যুবকদের সেভাবে গড়ে তােলে না। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে আজ দেখা দিয়েছে বেকার সমস্যা । যে শিক্ষা জীবিকা অর্জনের কৌশল শেখায় না সে শিক্ষা যে নিরর্থক ও নিষ্ফল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারের উপায়
আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান । কিন্তু কেবলমাত্র কৃষির উপর নির্ভর করে কোন দেশ টিকে থাকতে পারে না । এজন্য কৃষির পাশাপাশি শিল্প কারখানার প্রসার ঘটাতে হবে । এ ব্যাপারে সরকার ও বিত্তবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে । বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার কুটির শিল্প যেমন বস্ত্রশিল্প মৃৎশিল্প কাঁসাশিল্প কাঠশিল্প ইত্যাদির বিকাশ ঘটিয়ে বৃত্তিমূলক কাজের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে । দেশে শিল্পের বিকাশ ঘটলে বিভিন্ন প্রকার কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটবে এবং বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে । সরকার ইচ্ছা করলে স্কুল কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থাও চালু করতে পারেন । তাছাড়াও বহুমুখী কারিগরি শিক্ষালয় স্থাপন করে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে ।
কর্মমুখী শিক্ষার উপকারিতা
কর্মমুখী শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে প্রবর্তনের ক্ষেত্রে নানারকম সমস্যা থাকলেও এর উপকারিতাকে অস্বীকার করা যায় না।। কর্মমুখী শিক্ষার নানারকম উপকারিতা রয়েছে যেমন- (ক) এ শিক্ষা অর্জন করলে বেকারত্বের অভিশাপ হ্রাস পাবে (খ) সহজে কাজ পাওয়া যায় (গ) উপার্জনশীল হওয়া যায় (ঘ) ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে (ঙ) সাধারণ শিক্ষার ওপর চাপ কমে আসবে (চ) স্বাবলম্বী বা স্বনির্ভর হওয়া যায় (ছ) জীবনের হতাশা শূন্যতাবোধ এবং ব্যর্থতাজনিত গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়া যায় (জ) নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় ইত্যাদি।
উপসংহার
বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ প্রতিযোগিতার যুগ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এখন নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সময়। তাই আমাদের উচিত আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের সাথে সাথে জাতীয় জীবনেও অবদান রাখার সংকল্প করা। শুধুমাত্র স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এ যুগে লাভ নেই। এখন নানানপ্রকার বৃত্তিতে আত্মনির্ভরতার চাবিকাঠি লুকানো আছে। সুতরাং কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদের উচিত সাধারণ শিক্ষার দিকে ঝাঁপিয়ে না পড়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় নিজেদেরকে শিক্ষিত করে তোলা। তাহলে একদিকে যেমন নিজের উন্নতি নিশ্চিত হতে পারে তেমনি হতে পারে দেশের কল্যাণ।