মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
ভূমিকা
হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। বাঙালির প্রাকৃতিক পরিবেশেই মিশে আছে প্রতিবাদের ভাষা। বিদেশি শক্তির আগ্রাসন এ জাতি কোনােদিনই মেনে নিতে পারেনি। তাই পরদেশি শােষকদের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে বার বার বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। স্বাধীনতার জন্য মুক্তির জন্য আত্মদানের রক্তে বারংবার সিক্ত হয়েছে বাংলার মাটি।অবশেষে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি অর্জন করে প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক সে মুক্তিযুদ্ধ যে বােধ বা চেতনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল তারই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তাকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের প্রেরণা জোগাবে অনন্তকাল।
মুক্তিযুদ্ধ কি
মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে প্রাথমিকভাবে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর মুক্তি বা স্বাধীনতা লাভের জন্য লড়াই। এই লড়াই একটি ঔপনিবেশিক শক্তিকে উৎখাত করার জন্য হতে পারে অথবা কোন স্বৈরশাসক বা একনায়ককে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্য হতে পারে। এই যুদ্ধ দুটি বাহিনীর মধ্যকার নিয়মিত বা সাধারণ যুদ্ধের ন্যায় না এর বিস্তৃতি ব্যাপক। মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞার জন্য ইংরেজী ও বাংলা অভিধান ঘাঁটলে আরো স্বল্প পরিসরে মোটামুটি এমন সংজ্ঞাই পাওয়া যায়। এই সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে মুক্তি নামক একটি সাধারণ অনুমিতি আছে। বস্তুতঃ এই মুক্তি ব্যাপারটি পরিষ্কার হলে তার জন্য যুদ্ধের ব্যাপারটিও পরিষ্কার হয়।
জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের জাতাকলে প্রায় দুশ বছর ধরে নিষ্পেষিত হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশ। ১৯৪৭ সালে সে নিষ্পেষণ থেকে উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ মুক্তিলাভ করলেও মুক্তি মেলেনি বাঙালি জাতির। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও পাকিস্তানি শাসকদের শৃঙ্খলে বন্দি হতে হয় বাঙালি জাতিকে। সেসময় বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের সংকীর্ণ মনােভাব ও শােষণ নিপীড়ন এদেশের মানুষকে ভাবিয়ে তােলে। এর মধ্য দিয়ে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালি নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এ জাতীয়তাবাদী চেতনার নিরিখেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে সংগ্রাম করে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে বাঙালি।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ এ অঞ্চলের মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এদেশের জনমানসে অসন্তোষ ও ক্ষোভ ক্রমশই তীব্র হতে থাকে। এরই অনিবার্য ফল হিসেবে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার জয়লাভ ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরােধী আন্দোলন হতে ১৯৬৬ র ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর নজিরবিহীন গণ অভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন। এরপর ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ১৬৭টি আসনে। কিন্তু তারপরও ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়ার গড়িমসি ও ভুট্টোর ভেটো অব্যাহত থাকে। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭১ এর ১লা মার্চ হতে ২৫ এ মার্চ পর্যন্ত নজিরবিহীন অসহযােগ আন্দোলন চলতে থাকে। লাখ লাখ জনতার উপস্থিতিতে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করার আহ্বানে স্বাধীনতার ডাক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২৫ এ মার্চ রাতে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ এ মার্চ মধ্যরাত শেষে অর্থাৎ ২৬ এ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা করেন এবং বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে বাংলাদেশ স্বাধীন করাে এ স্বতঃস্ফুর্ত স্লোগান দিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে সমগ্র বাঙালি জাতি একাত্ম হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নিরিখে শােষকশ্রেণির অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভুটান ও ভারত পর্যায়ক্রমে সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দান করে। ভুটানের প্রথম স্বীকৃতির কয়েক ঘণ্টা পরে বেলা বেলা ১১টার সময় অল ইন্ডিয়া রেডিও All India Radio মারফত ভারত বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্বীকৃতি প্রদান করে এবং সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে কূটনৈতিক স্বীকৃতি।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ
১৯৭১ সালের ২৫ এ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পিলখানা রাজারবাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মধ্যরাতের পর হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বেই অর্থাৎ ২৬ এ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তার স্বাক্ষরিত ঘােষণা বার্তাটি তৎকালীন ইপিআর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। এরপর চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ এ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত হয় স্বাধীনতার ঘােষণা। সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে স্বতঃস্ফুর্ত মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এমনিভাবে নয় মাস যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আমাদের যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে তার মূলে কাজ করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গত চার দশকে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত হয়েছে আমাদের সমাজজীবনে।ব্যক্তিস্বাধীনতা নারীমুক্তি আন্দোলন নারীশিক্ষা গণশিক্ষা সংবাদপত্রের প্রচার প্রকাশনার বিকাশ সর্বোপরি গণতান্ত্রিক অধিকার ও চেতনা বিস্তৃত হয়েছে সমাজে। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে প্রবল গণজোয়ারের মধ্য দিয়ে নবতর বিজয় অর্জন ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারও প্রেরণা জুগিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতা ও কথাসাহিত্যে এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে কবিতাচর্চা তথা সাহিত্যচর্চা আজকে যতটা ব্যাপ্তি পেয়েছে তার পেছনে বড় প্রেরণা হিসেবে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপ্তি ঘটেছে আমাদের গান এবং নাটকে। গণসচেতনতামূলক বক্তব্যধর্মী নাটক ব্যাপকভাবে রচিত হয়েছে স্বাধীনতার পর। আমাদের দেশাত্মবােধক গানের ক্ষেত্রে এক নতুন জোয়ার এনেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অসংখ্য গীতিকার তাদের গানে রচনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা। আমাদের চলচ্চিত্রেও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা প্রকাশ পেয়েছে নিয়মিতভাবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ও আজকের বাংলাদেশ
যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণেই গত চার দশকেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর বারবার সামরিক অভ্যুত্থান হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতা অর্থনৈতিক বৈষম্য যুবসমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা বেকারত্ব জনস্ফীতি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘুষ দুর্নীতি ইত্যাদি অবক্ষয় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপন্ন করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী কার্যকলাপ বারবার সংঘটিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে এবং বাইরে। প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়ােজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ। এজন্য দুর্নীতিমুক্ত ও কল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়ােজন তেমনি প্রয়ােজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাথা আর আত্মত্যাগের ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
স্বাধীনতার ঘােষণা
২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞে সারা বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমনি অবস্থায় গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার ঘােষণা দেন তা ওয়ারলেসের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ. হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করলে সারাদেশে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর ২৭ মার্চ একই বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান জিয়াউর রহমান আবারও ঘােষণাপত্র পাঠ করলে সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এভাবেই সশস্ত্রে মুক্তিসংগ্রাম গড়ে ওঠে।
অস্থায়ী সরকার গঠন
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে। শেখ মুজিবুর রহমান এর অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দিন আহমদের তাজউদ্দিন আহমেদ উপর। বাংলাদেশের প্রথম সরকা দেশি বিদেশি সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণ
১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষদিকে মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর হয়ে ওঠে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। ৪ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তােলে। ৬ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৪ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশে পাকবাহিনীর সবগুলাে বিমান দখল করে নেয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়।
পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও চুড়ান্ত বিজয়
১৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী ঢাকার মাত্র ১৪ কিলােমিটার দূরে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। প্রায় ৯৩০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান।বাংলাদেশের মানুষের বহু আকাঙ্ক্ষিত বিজয় ধরা দেয় যুদ্ধ শুরুর নয় মাস পর। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও সারা দেশে সকল পাকিস্তানি সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করাতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের Bay of Bengal দক্ষিণতম প্রান্তে প্রবেশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের দখল থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।
মুক্তিযুদ্ধে বৈদিশিক সাহায্য সহযােগিতা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্র বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকবাহিনীর অত্যাচারে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার এসব উদ্বাস্তুদের খাদ্য বস্ত্র ঔষধ দিয়ে সাহায্য করে। রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরােপীয় দেশগুলাের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশকে সহযােগিতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী পাকবাহিনীর নির্যাতন হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলে। এ সময় আমেরিকা ও চীন এই দুই পরাশক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও তাদের জনগণ বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি একাত্মতা ঘােষণা করে। অবশেষে বৈদেশিক সাহায্য ও মুক্তিবাহিনীর নিরলস চেষ্টায় নয় মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
২৫শে মার্চের কালরাত্রি
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের পর জনগণের মধ্যে দেখা দেয় স্বাধিকার চেতনা। সকলে সংগ্রামী মনোভাব দেখাতে শুরু করে। তখন পাকিস্তানিরা বাঙালিকে দমাতে নতুন পরিকল্পনা করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসে অস্ত্রধারী ট্যাঙ্ক ও গোলাবারুদ। ২৫ শে মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। সেদিন এক রাতে ঢাকায় প্রায় ২০ হাজার মানুষকে নিরীহভাবে হত্যা করা হয়। অবস্থা বুঝতে পেরে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাকে সেখানেই বন্দি করে রাখা হয়।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধো
২৫শে মার্চের সেই নারকীয় হত্যার পরই বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ মর্ম বুঝতে পারে। তাই ২৬ শে মার্চ থেকেই সকল বাঙালি যে যা পারে তাই নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ঝাপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিকেরা। তাছাড়া তৎকালীন বাঙালী পুলিশ ইপিআর আনসার বাহিনীরাও একযোগে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। অনেকে সাহসী বাঙালী তরুণেরা দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। তাদের সাথে যোগ দেয় যোগ দেয় স্কুল কলেজের ছাত্র ও দিনমজুর, কৃষক ও শ্রমিকেরা।
মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হবার পর জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে মুক্তিবাহিনী। প্রথমে এর সংখ্যা ছিল ১৩০০০। তারপর দলে দলে বাংলার সাহসী তরুণেরা অংশগ্রহণ করতে থাকে। জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার চিফ ইন চার্জ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় নিয়মিত বাহিনী ও অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর অধীনে সারা দেশে তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠন করা হয় যা কে ফোর্স জেড ফোর্স ও এস ফোর্স নামে পরিচিত। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার জন্য দেশেকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত বাহিনী সাফল্যের সাথে যুদ্ধ করে যায়। অতঃপর জুন মাসে অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১০ নং সেক্টরের অধীনে থাকা নৌ কমান্ডো বাহিনীও অত্যন্ত বীরত্ব ও কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করে।
মুজিবনগর সরকার গঠন
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠণ করা হয় যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ ইউনিয়নের আমবাগানে এই সরকার শপথ গ্রহণ করে। এই দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সেই সরকার কাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে মেহেরপুর জেলার ঐ জায়গাটিকে মুজিবনগর নামে নামকরণ করা হয়।
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুজিবনগর সরকারের প্রধান কাজই ছিল বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা। মুজিবনগর সরকারের দেশে ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। মুজিবনগর সরকার মুক্তিবাহিনীর সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ ও বিদেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এ সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের মতো বিরূপ পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বজায় রাখা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ যা এই সরকার খুব ভালোভাবে পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণ ও পেশাজীবীদের ভূমিকা
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল বাংলার সাধারণ জনগণ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারা একযোগে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। দেশের ছাত্র জনতা পুলিশন ইপিআর কৃষকস শ্রমিক পেশাজীবী সকলেই মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেকে দিয়েছে নিজেদের প্রাণ আবার অনেকে পঙ্গু অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই ঋণ কোনোদিনও শোধ করা যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের সকল মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। তাই একে গনযুদ্ধ বা জনযুদ্ধও বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুক্তিযোদ্ধারাই ছিলেন আসল দেশপ্রেমিক। তারা ছিলেন অসীম সাহসী দেশের বীর সন্তান ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ যোদ্ধা। নিজেদের জানের মায়া ত্যাগ করে তারা দেশকে স্বাধীন করেছিল। তাদের এই ত্যাগ জাতি চিরকাল স্মরণে রাখবে।
মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নেতৃত্বদানকারী দলটির নাম হলো আওয়ামী লীগ। মূলত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বই মুক্তিযুদ্ধের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে। তারা ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধিকার চেতনার জাগরণ ঘটায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেকগুলো রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ন্যাপ(ভাসানী) ন্যাপ(মোজাফফর) কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় কংগ্রেসস ইত্যাদি। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিছু দল পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ রাজাকার আলবদর আল শামস ইত্যাদি। তারা হত্যান লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ সহ নানান ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেখানে ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। গোটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব ছাত্র জনতা। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়। পাকিস্তানি আমলে প্রতিটি আন্দোলনের মূল আহবায়ক ছিল ছাত্ররাই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তারাই নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। এরপর ১৯৫৪ ১৯৬৬ ১৯৬৯ ১৯৭০ এর প্রতিটি আন্দোলনেই তারা রেখেছিল সক্রিয় ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র জনতা ভ্যানগার্ড নামে অধিক পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে দেশের আনাচে কানাচে থেকে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা একযোগে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। অনেক শিক্ষার্থীরা বাবা-মা কে লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সাথে। তারা চলে যায় সিমান্ত পেরিয়ে পাশের দেশ ভারতে। সেখানে গিয়ে তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ও গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা নাজেহাল করে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে নারীরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অনেক নারীরাই প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি রণাঙ্গনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন নিজের জীবন বাজি রেখে। নারীরা কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে আবার কখনো যুদ্ধেক্ষেত্রের আড়ালে। তারা সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়েছেন প্রেরণা দিয়েছেন অচেনা অজানা অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা সুশ্রুষা করেছেন। নিজেরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করেছেন। অনাহারী অর্ধাহারী ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা কখনো সেবা দিয়েছেন নিজের বোনের মতো কখনো মায়ের মতো। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে নিজেদের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য নারীরা তেমন কোনো বিশেষ স্বীকৃতি পাননি। অনেক নারীযোদ্ধারাই হারিয়ে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে ও অনুপ্রেরণা জোগাতে এবং জনগণের মনে আধার সঞ্চার করতে ও দেশে বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয় অসংখ্য নিয়মিত এবং অনিয়মিত পত্রিকা। এসব পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার বীরসেনাদের সাহসীকতার চিত্র এবং পাকবাহিনীর ধ্বংসলীলার দৃশ্য। পত্রিকাগুলোতে এ সম্পর্কে লেখা হতো বিভিন্ন প্রবন্ধ ছড়া রচনা কবিতা গল্প গান কার্টুন ইত্যাদি। সেই সময়ে লেখা সেই পত্রিকাগুলো আজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোতেও বাঙালির বীরত্ব সাহসিকতা পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে অবস্থানকারী বাঙালিরাও বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। মূলত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা সরবরাহকারী বাহিনীর ভূমিকায় কাজ করছেন। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে ছুটে গিয়েছেন। এছাড়াও তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে। পাকিস্তানকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ না করার জন্য বিভিন্ন প্রবাসী সরকারের নিকট আবেদন করেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের ক্ষেত্রেও তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ছিল জনগণ। তবে দেশের শিল্পী সাহিত্যিকরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের পত্র পত্রিকায় লেখা বেতার কেন্দ্রের খবর পাঠ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা বিভিন্ন ধরণের দেশাত্মবোধক গান ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান কবিতা নাটক কথিকা ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বজায় রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্র ও জল্লাদের দরবার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অনুপ্রাণিত করে। এককথায় দেশের সকল বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে এবং জনগণকে শত্রুর নিকট দুর্দমনীয় করে তুলেছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও দায়িত্ববোধ
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে আমাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাই বর্তমানে এই স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টা বাস্তবায়ন করতে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে। দেশের সকল জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যেন তারা দেশের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। দেশের সকল দেশপ্রেমিক শিল্পপতি চাকরিজীবী ব্যবসায়ী বুদ্ধিজীবী ও সকল কর্মকার্তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে সকল বিরোধের ঊর্ধে থেকে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। দেশকে একটি দারিদ্রমুক্ত সুশিক্ষিত ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।
উপসংহার
স্বাধীনতা যে মানুষের জন্মগত অধিকার বাংলাদেশের মানুষ তা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম এই স্বাধীনতা। এর মাধ্যমে অবসান ঘটেছিল পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছরের শাসন শোষণ ও নিপীড়নের। তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমরা এখনো বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা গড়তে পারিনি। স্বাধীন জাতি হয়েও স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ এখনো আমরা পাইনি। তাই সকল সংকটকে দূরে ঠেলে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের নিজেরদেরকে দেশপ্রেম কর্তব্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই আমরা রক্ষা করতে পারব আমাদের স্বাধীনতাকে।