বাংলাদেশের ষড়ঋতু
↬ ষড়ঋতুর বাংলাদেশ
↬ ঋতুচক্র ও বাংলাদেশ
↬ বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য
↬ রূপসী বাংলা
↬ বাংলাদেশের নিসর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব
ভূমিকা
ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক— সকল দেশের সেরা;
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা— দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা ষড়ঋতুর এ বসুন্ধরার রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথায়ও দেখা যায় না। বাংলার প্রকৃতিতে রূপ, রস, গন্ধ অবিরত রং বদলায়। ঋতুবৈচিত্র্যে বাংলার প্রকৃতি সাজে নানান সাজে। অফুরন্ত এ রূপ সর্বদা নব নব সাজে সজ্জিত হয়। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ বৈচিত্র্যময় দেশ কখনো ভৈরবী রূপ নেয়, কখনো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, কখনো সজল কালো চোখ তুলে ভালোবাসার বান ছুঁড়ে দেয় প্রকৃতির সন্তানদের দিকে। কখনো কিশোরী মেয়ের মতো বাঁকা চায়, কখনো যৌবন রসে সিক্ত করে সবাইকে। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার অফুরন্ত রূপ কখনো ফুরিয়ে যায় না।
ষড়ঋতু নাম তো আমাদের সকলেরই জানা। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এক এক ঋতুর এক এক বৈচিত্রের বর্ণনা দেওয়া হলো।
রুদ্র গ্রীষ্ম
ঋতুরঙের প্রথম কুশীলব গ্রীষ্ম। ধু ধু রুক্ষ দুই চোখে প্রখর বহ্নিজ্বালা নিয়ে তার আবির্ভাব। সূর্যের প্রচণ্ড শাসনে ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ। প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে। সেই তৃষ্ণাকাতর বিরহের নিরুদ্ধ নিঃশ্বাস উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে অপরাহ্ণে। আদিগন্ত মরুজ্বালার মধ্যে গ্রীষ্ম সন্ধ্যা যেন একটি শ্যামল স্নিগ্ধ মরূদ্যান। কালবোশেখি যে রুদ্রসুন্দর মূর্তি আকাশ মাটির দেহের উত্তাপ মুছে নিতে আসে শুশ্রূষার সুগভীর প্রতিশ্রুতির মতো। যা জীর্ণ ও গতায়ু, তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গ্রীষ্ম নববিধানের দুর্ধর্ষ আশ্বাসবাণী ঘোষণা করে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মের ডালি ভরে ওঠে সুরসাল আম জাম কাঁঠালের প্রাচুর্যে। গ্রীষ্ম ফুলের ঋতু নয়, ফুল ফোটাবার তাড়া নেই তার, শুধু ফলের ডালা সাজিয়েই নিঃশব্দে বিদায় নেয় সে। গ্রীষ্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি সুফিয়া কামাল তাঁর ‘গ্রীষ্ম’ নামক কবিতায় লিখেছেন—
“আমি গ্রীষ্ম। আসিলাম বসন্তের পরিত্যক্ত পথে
ধূসর ঊষর রুক্ষ। ধূলি-ম্লান বহুদূর হতে।
অপেক্ষি’ আমার লাগি কেহ নাহি। শিশিরাশ্রু আঁখি
সিক্ত নব কিশলয়। আমি গ্রীষ্ম পরম একাকী।”
নবীন বর্ষা
রূপসী বাংলার বুকে গ্রীষ্মের পর আসে শ্যামল সরস সজল নবীন বর্ষা। গ্রীষ্মের লেলিহান হোমশিখাকে আবৃত করে দূর দিগন্তে ধূসর আকাশের বুকে স্তরে স্তরে জমে ওঠে নবীন মেঘের স্তূপ। এক অপূর্ব সমারোহে আকাশ-বাতাস ব্যাপ্ত করে রাজ রাজেশ্বরের মতো আসে বর্ষা। বর্ষমঞ্চের দ্বিতীয় কুশীলব সে। বর্ষা বাংলাদেশের সবচেয়ে জীবন্ত ঋতু। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ বিকাশ ও গুরুগম্ভীর বজ্রনিনাদের ‘অতি ভৈরব হরষে’র মধ্যে সূচিত হয় তার শুভাগমন। তাই বাংলাদেশের ষড়ঋতু নিয়ে কবিতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতায় বলেছেন—
“ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জল সিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ ভরষে
ঘন গৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা। “
বর্ষার আগমনে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যে বিপুল পরিবর্তন আসে, অন্য কোনো ঋতুতে তা দেখা যায় না। পল্লিপ্রকৃতিতে বর্ষা নিয়ে আসে যৌবনের উদ্দামতা। অবিশ্রান্ত বর্ষণে মাঠঘাট, খালবিল, নদীনালা ভরে যায়। দূর দিগন্ত থেকে দুরন্ত বায়ু ছুটে আসে হা হা শব্দে। শুরু হয় শীতল ধারাবর্ষণ। বহুদিন পরে আবার শোনা যায় নানা সংগীতমুখর পাখির কূজন। মাটির কঠিন শাসন ভেদ করে নবীন শস্যশিশুর দল বেরিয়ে পড়ে নবজীবনের জয়যাত্রায়। প্রকৃতির ধূলি বিষণ্ন অঙ্গ থেকে গ্রীষ্মের ধূসর অবসাদ মুছে গিয়ে ঘনিয়ে আসে সজল বর্ষাপ্রকৃতির পুষ্প বিকাশের পরম লগ্ন।
কদম্ব, কেয়া, জুঁই, গন্ধরাজ, হাস্নাহেনার বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের উৎসবে বাংলার প্রকৃতির হৃদয়ের দ্বার যেন খুলে যায়। তারপর বেজে ওঠে বর্ষা বিদায়ের বিষণ্ন মাদল। শেষ বর্ষণের পালাগান গেয়ে, পথে পথে কদম্ব কেশরের স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে বাংলার পল্লিপ্রকৃতিকে হাসিয়ে কাঁদিয়ে বিদায় গ্রহণ করে রূপময়ী, রসময়ী বর্ষা। এই দৃশ্যের অনুভব থেকেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘চক্রবাক’ কাব্যের ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় বলেছেন—
“ওগো ও জলের দেশের কন্যা! তব ও বিদায়-পথে
কাননে কাননে কদম কেশর ঝরিছে প্রভাত হতে।”
অমল ধবল শরৎ
বৈচিত্র্যময় রূপৈশ্বর্যের রানী বাংলার তৃতীয় ঋতু শরৎ। অমল ধবল পালে ছন্দ মধুর হাওয়া লাগিয়ে প্রকৃতিতে আবির্ভাব ঘটে শরতের। বর্ষণক্লান্ত মেঘ তার বারিবর্ষণ মুছে ফেলে লঘুতর রূপ গ্রহণ করে— অলস মন্থর গতিময় ছন্দে আকাশের একাংশ শূন্য করে অন্য অংশে ভেসে যায়। বর্ষার প্রকৃতিকে ধুইয়ে শুদ্ধ কোমল রূপকান্তিতে সাজিয়ে দিয়ে যায়। আর শরত্রানী আলো-আঁধারির লুকোচুরির খেলায় নিজেকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাখে। কাশফুলের শুভ্রতায় প্রকৃতিতে শান্তির পরশ লাগে। শিউলি ফুলের মন উদাস করা গন্ধ মানবমনে ভালোবাসা জাগিয়ে দেয়। ভোরের শিশিরের কোমলতা নিয়ে প্রকৃতি মানবমনে সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়। শরতের রূপে মুগ্ধ কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
“আজি কী তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে।
হে মাতঃ বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।”
শরতে পৃথিবী যেন সদ্যস্নাতা তরুণীর মূর্তি পরিগ্রহ করে দেখা দেয় অপরূপ মহিমায়। তারই বন্দনায় গাছ থেকে শেফালি ঝরে পড়ে। শরতের মূর্তিতে নিহিত রয়েছে একটি পরিতৃপ্তির হাসি। বাঙালি হিন্দু সমাজের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজার আয়োজনে মুখর হয়ে ওঠে বাংলার গ্রাম ও নগর। তবে শরতের অবসর কম। রাতে তার শেফালি ঝরে যায়, ধানের ক্ষেতে তার সৌন্দর্য পলকে পলকে নতুন হয়, বন-উপবন দোয়েল কোয়েলের। কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।
সুমঙ্গলা হেমন্ত
শরত্রানীর বিদায় বার্তা ঘোষিত হতেই হিমের ঘন ঘোমটায় মুখ ঢেকে হেমন্ত এসে উপস্থিত হয়। সে বঙ্গ ঋতুনাট্যের চতুর্থ কুশীলব। হেমন্তের নেই শরতের বনৈশ্বর্য, আছে সুদূর ব্যাপ্ত এক বৈরাগ্যের বিষণ্নতা। সে যেন ফসল ফলানোর নিঃসঙ্গ সাধনায় থাকে নিমগ্ন। ক্ষেতে খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান উঠতে থাকে। চারদিকে অন্তহীন কর্মব্যস্ততা। ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্নের উৎসব। কবি জাহানারা আরজুর ভাষায়—
“চারদিকে মউ মউ নবান্নের ঘ্রাণ—
কার্তিকের সোনা ধানে ভরে যায় গোলা,
হেমন্তের দিনগুলো আসে ঝকঝকে
সোনার থালায় —”
হেমন্ত আবহমান বাংলার এক আনন্দময় উৎসবের ঋতু। হেমন্তের জীবন ত্যাগের মহিমায় প্রোজ্জ্বল। ঘরে ঘরে ফসলের সওগাত বিলিয়ে দেওয়ার জন্য যেন তার আগমন ও অবস্থান। নিজেকে উজাড় করে দেওয়াই যেন তার মহান ব্রত। নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মধ্যেই তার সার্থকতা। নতুন শাক-সবজির পসরা বহন করে আনে মানুষের দুয়ারে। মানুষকে বাঁচানোর উপকরণ হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নেয় হেমন্ত। তাই কবি বলেছেন—
“ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে॥”
হাড় কাঁপানো শীত
হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পর আসে জড়াগ্রস্ত শীতের ধূসর বার্ধক্য। শুষ্ক কাঠিন্য, পরিপূর্ণ রিক্ততা ও দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি সে। তার তাপ বিরল রূপমূর্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে এক মহামৌনী তপস্বীর তপশ্চর্যা এবং অনন্ত বৈরাগ্যের ধূসর অঙ্গীকার। বিবর্ণ কানন বীথির পাতায় পাতায় নিঃশেষে ঝরে যাওয়ার নির্মম ডাক এসে পৌছায়। এক সীমাহীন রিক্ততায় অসহায় ডালপালাগুলো একদিন হাহাকার করে কেঁদে ওঠে। তাকে সব দিয়ে দিতে হয়, দিয়ে যেতে হয়। ওদিকে, ধান কাটা মাঠে কী সীমাহীন শূন্যতা, বিশাল কারুণ্য। ত্যাগের কী অপরূপ মহিমা! হেমন্তে যে নবান্নের উৎসব শুরু হয়, তার অবসান ঘটে হাড়কাঁপা শীতের শাসানিতে। শীতের আগমনের সাথে সাথে প্রকৃতির ওপর যে শাসন ও শোষণ শুরু হয়ে যায়, তাতে প্রকৃতি তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে রুক্ষ হয়ে ওঠে। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন—
“ওগো শীত, ওগো শুভ্র, হে তীব্র নির্মম,
তোমার উত্তর বায়ু দুরন্ত দুর্দম
অরণ্যের বক্ষ হানে। বনস্পতি যত
থরথর কম্পমান, শীর্ষ করি নত
আদেশ-নির্ঘোষ তব মানে।”
নবজীবন বসন্ত
ঋতুচক্রের সর্বশেষ ঋতু বসন্ত। শীতের ত্যাগের সাধনা তো বসন্তের নবজন্মের প্রতীক্ষায়ই। বসন্ত আসে নবীন প্রাণ, নবীন উৎসাহ, নবীন উদ্দীপনা নিয়ে, যৌবনের সঞ্জীবনী রসে পরিপুষ্ট হয়ে। তার সুখময় স্পর্শে গাছে গাছে জেগে ওঠে কিশলয়। পাখির কলকাকলিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। দূর বনান্তরাল থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহুগীতি পৃথিবীতে সৃষ্টি করে এক অপরূপ মায়া নিকেতন অশোক পলাশের রঙিন বিহ্বলতায় ও শিমুল কৃষ্ণচূড়ার বিপুল উল্লাসে, মধুমালতী ও মাধবী মঞ্জরীর উচ্ছল গন্ধমদির প্রগলভতায় সারা আকাশতলে গন্ধ, বর্ণ ও গানের তুমুল কোলাহলে লেগে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি। বসন্তকালে গাছে গাছে নানা ফুল ফোটে। তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই কবি বসন্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন—
“হে বসন্ত, হে সুন্দর, ধরণীর ধ্যানভরা ধন, বৎসরের শেষে।
শুধু একবার মর্ত্যে মূর্তি ধরো ভুবনমোহন নব বরবেশে৷”
উপসংহার
রূপসী বাংলার এই ঋতুরঙ্গমালা নানা বর্ণ, গন্ধ, গানের সমারোহে নিত্য আবর্তিত হয়ে চলে। ষড়ঋতুর রঙ্গমঞে এমনি করে প্রতিটি ঋতু যুগ যুগ ধরে অভিনয় করে যাচ্ছে। একের পর এক তাদের আগমন ও অন্তর্ধান বাঙালির প্রাণে রঙ ধরায়। এই ঋতুচক্রের অবদানেই আমাদের বাংলাদেশ হয়েছে সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা এবং অরণ্যকুন্তলা।
1 Comment
Its essay is so good… but its not very points.Only 8 points.i need a 15 points..please kindly 15 points share….thanks..