মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার
ভূমিকা
বর্তমান যুগে মাদকাসক্তি বিশ্বের প্রায় সব দেশের একটি প্রধান সমস্যা হয়ে। দাঁড়িয়েছে। বিশেষতঃ তরুণ সমাজ মাদকাসক্তির কবলে পড়ে তিলে তিলে তাদের জীবন নিঃশেষ করে ফেলছে। এর সাথে সাথে সমাজে নানা অপরাধ প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাদক দ্রব্যের প্রকারভেদ
মাদক দ্রব্য অতীতকাল হতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু এখনকার মত তা তেমন সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করেনি। অতীতে কিছুসংখ্যক লোক অতি গোপনে তা ব্যবহার করত। মাদকদ্রব্য বলতে নেশা সৃষ্টিকারী কতকগুলো দ্ৰব্য বুঝায় যেমন- মদ গাঁজা ভাং আফিম চরস মরফিন হেরোইন মারিজুয়ানা কোকেন হাসিস পেথেডিন ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে মদ পাশ্চাত্য দেশে পানীয় হিসেবে ব্যাপকভবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং তা গ্রহণে সেসব দেশে কোন বাধা নেই। ইদানিং যে মাদকদ্রব্যটি আমাদের দেশে তরুণ সমাজকে সর্বাধিক আকৃষ্ট করেছে, তার নাম হেরোইন। এর দাম অধিক এবং ব্যবহারও ক্রমান্বয়ে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মাদকাসক্তির ক্ষতিকর দিক
মাদকদ্রব্য গ্রহণের আসক্তি সুপাচীন কাল থেকে প্রচলিত থেকে যুগে যুগে সমস্যার সৃষ্টি করছে। এক সময় চীন দেশের লোকজন আফিম খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। সাম্প্রতিককালে মাদকাসক্তির প্রভাবে বহুলোকের বিশেষত যুবসমাজের ধ্বংস নেমে আসছে শুরু হয়েছে এক ভয়াবহ অবক্ষয়ের। বিভিন্ন রকম দৈহিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে দেহের অক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মাদকাসক্তির ফলে মানসিক ভারসাম্যহীন্যতার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন চেতনা নাশক মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে মানসিক আচ্ছনতা দেহের মাংসপেশির কম্পন ও মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ফলে মাদকাসক্তির পরিণাম হিসেবে ব্যক্তিজীবনে আসে ব্যর্থতা এবং জাতীয় জীবনে আসে সর্বনাশ।
মাদকাসক্তির প্রভাব
সারা বিশ্ব জুড়ে মাদকাশক্তি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক উন্নত দেশে মাদকাসক্তির ব্যাপকতা জাতির জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। এই সর্বনাশা নেশা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকদ্রব্যের প্রসারের ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সর্বনাম নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। তবে তরুণ সমাজের মধ্যে এর সম্প্রসারণের প্রবণতা খুব বেশি। শিক্ষাজীবনের অনিশ্চয়তা বেকারত্বের অভিশাপ দারিদ্রের গ্রাস এসব কারণে যুবসমাজ ক্রমেই নেশার দিকে ধাবিত হচ্ছে। নেশাগ্রস্তদের নৈতিক মূল্যবোধের অভাবের কারণে তারা অন্যায় ও অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে। মাদকদ্রব্যের দাম বেশি হওয়ায় নেশাগ্রস্তরা অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনে তৎপর হচ্ছে। মাদকদ্রব্যের ব্যাপক ব্যবহারের প্রেক্ষিতে এবং ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সহজেই ধারণ করা যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর ন্যায় আমাদের দেশেও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের যুবসমাজ মারাত্মকভাবে মাদকাসক্তির শিকার বাংলাদেশে কী পরিমাণ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হয় এবং কত লোক মাদকাসক্ত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান এখনো নেই। তবে এদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭ ভাগ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে বলে বিশেষজ্ঞ ধারণা। দেশে ৩৫০টি বৈধ গাজার দোকান আছে। দর্শনার রয়েছে সরকার অনুমোদিত একমাত্র মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেরু এন্ড কোম্পানি। বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেশীয় মদ প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন ও বিক্রি হয়।
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার
আজকাল মাদকদ্রব্য বিভিন্নভাবে সেবন বা গ্রহণ করা হয়। এক ধরণের মাদক আছে যা নাকে টানা হয়। আবার কোনো দ্রব্য ধোয়ার সাথে পান করা হয়। কোনটি গিলে খাওয়া হয়। আবার কোনটি ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে দেখা গেছে যে বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ১৫ লক্ষের মতো মাদক সেবনকারী রয়েছে এবং এর সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে। বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রমজীবী থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরাও নেশায় আক্রান্ত হছে।
মাদকদ্রব্যের ধরণ বা প্রকার
বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্য চালু রয়েছে। মদ গাঁজা ভাং আফিম ইত্যাদি অনেক প্রাচীনকালের। বর্তমানের হেরোইন মারিজুয়ানা এল.এস.ডি, হাসিস কোকেন প্যাথিড্রিন ফেনসিডিল ইত্যাদি বেশি প্রচলিত। এ পর্যন্ত যেসব মাদকদ্রব্যের কথা জানা গেছে তার মধ্যে নারকাটকসই প্রধান। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে হেরোইন সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য। অন্যান্য মাদকদ্রব্যের চেয়ে এর দাম তুলনামূলক বেশি এবং নেশায় আক্রান্ত করে গভীরভাবে।
মাদক দ্রব্যের অপকার
মাদকদ্রব্য নেশা সৃষ্টি করে। তাই এতে একবার অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তা হতে রেহাই পাওয়া বড়ই কঠিন। মাদক দ্রব্যের মধ্যে হেরোইন একটি মারাত্মক নেশা। হেরোইনে আসক্ত ব্যক্তি নেশার সময় তা না পেলে অস্থির হয়ে পড়ে। মাদকদ্রব্য স্নায়ুবৈকল্য ঘটায় মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে আলসার ক্যানসার ইত্যাদি মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টি করে। এটা পাওয়ার জন্য নেশাসক্ত ব্যক্তি অর্থ সংগ্রহের জন্য যে কোন হীন কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। মাদকদ্রব্য মানুষের নৈতিক অধঃপতন ঘটায় এবং পারিবারিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা সাধারণতঃ কুচরিত্র লোকদের সাথে মেলামেশা করে এবং অপরাধী চক্র গড়ে তোলে। তারা চুরি ডাকাতি ছিনতাই হাইজ্যাক ইত্যাদি নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়। ফলে বিপথগামী ব্যক্তিরা সমাজ দেশ ও জাতির পক্ষে একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
মাদকাসক্তির কারণ
অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও মানসিক অশান্তি মাদকাসক্তির মূল কারণ। তবে সাধারণতঃ দু টি কারণে মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। প্রথমতঃ অনেকে নতুনত্বের মোহে তা গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ঃ কেউ কেউ হতাশা হতে সাময়িক মুক্তিলাভের আশায় তা গ্রহণ করে এবং পরে এতে আসক্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া পারিবারিক অশান্তি বেকারত্ব দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণেও অনেকে মাদক দ্রব্য গ্রহণ করে মনের দুঃখ জ্বালা সাময়িকভাবে ভুলতে চেষ্টা করে।
মাদক সেবনের কারণ
সাময়িক জীবনের প্রতি বিমুখতা ও নেতিবাচক মনোভাব থেকেই মাদকাসক্তির জন্ম। অভ্যাস থেকে আসক্তি ধূমপান একদিন পরিণত হয়। হেরোইন আসক্তিতে ধনতান্ত্রিক সমাজে ও অর্থনীতিতে ব্যক্তির ভোগের উপকরণ অবাধ ও প্রচুর। বর্তমানে সিনেমা ও টেলিভিশনে যেসব অশ্লীল নৃত্য ছবি কাহিনী ইত্যাদি দেখানো হচ্ছে সেসব অনুকরণ করতে গিয়ে তরুণ সমাজ তাদের নৈতিক অধঃপতন ডেকে আনছে। তাছাড়া আবার অনেকসময় অস্থিরতা কুচিন্তা অভাব অনটন পারিবারিক কলহের কারণে তরুণ সমাজ এই মোহের জালে আচ্ছন্ন হয়।
মাদকাসক্তির প্রতিকার
মাদকাসক্তির কবল হতে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন। স্বেচ্ছায় এটা বর্জন বা ভ্যাগ করাই হল এটা হতে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায়। আমাদের দেশে সামাজিক অস্থিরতার মূলে যেসব সমস্যা বিদ্যমান সেগুলোর প্রতিকার করে মাদকাসক্তির কবল হতে দেশকে রক্ষা করা যেতে পারে। তাছাড়া উপযুক্ত শিক্ষা সৎসংসর্গ নির্দোষ আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা বেকারত্ব দূরীকরণ ধর্মীয় শিক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে এর প্রতিকার করা যেতে পারে। তবে অভিভাবক সরকার সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে এটা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের দেশে মাদকদ্রব্য বিক্রয় আইনত নিষিদ্ধ কিন্তু এটা চোরাপথে আমদানি হয়ে অধিক লাভে বিক্রয় হয়। এটাকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
মাদকের উৎসভূমি
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (লাওস মায়ানমার থাইল্যান্ড) গোল্ডেণ ক্রিসেন্ট (আফগানিস্তান ইরান পাকিস্তান)। গোল্ডেন ওয়েজ হেরোইনের মূল উৎস। মাদকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলো আফিম। পপি ফুলের নির্যাস থেলে কৃষকরা তৈরি করেন কাচা আফিম। তা থেকে হয় মারফিন বেস। আফিম থেকেই তৈরি হয় সর্বনাশা হেরোইন। প্রাপ্ত তথ্যমতে যুক্তরাষ্ট্র কলম্বিয়া গুয়াতেমালা জ্যামাইকা ব্রাজিল প্যারাগুয়ের ঘানা নাইজেরিয়া কেনিয়া দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে মারিজুয়ানা উৎপন্ন হয়। হাশিস উৎপন্ন করার জন্য জ্যামাইকা মরক্কো জর্দান পাকিস্তান আফগানিস্তান ভারত ও নেপাল সমধিক পরিচিত।
মাদকদ্রব্য চোরাচালান
মাদকাসক্তির ব্যক্তিগত দিক ছাড়াও এর আরও একটি ব্যবসায়িক দিক আছে যা বিশাল অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত। মাদকদ্রব্য সাধারণত পাকিস্তান ও ভারত থেকে পাচার হয়ে যায় পশ্চিমে ইউরোপে। বিশেষ করে গ্রেট ব্রিটেন পসচিম জার্মানি ইতালি ও সুইজারল্যান্ড। শ্রীলঙ্কাকে ব্যবহার করা হয় চোরাচালানের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের মাঝামাঝি হওয়ার ফলে বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়া
মাদকের ভয়াবহ বিসার গোটা বিশ্বের জন্যে আজ উদ্বেগজনক। আজ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ জীবনে এটা এক নম্বর সমস্যা। প্রায় ৪ কোটি আমেরিকান নর নারী কোকেন সেবন করে কমপক্ষে ২ কোটি মারিজুয়ানা সেবন করে। ১২ লক্ষ হেরোইনসেবী। এই অবস্থা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোতেও রয়েছে। কিন্তু সমস্যা এখন শুধু ইউরোপ আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই অশুভ ছায়া এশিয়া আফ্রিকার দেশে দেশে ইতোমধ্যেই আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বজুড়ে মাদক বিরোধী আন্দোলন বনাম বাংলাদেশ
বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম মাদকপ্রতিরোধ আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। এরপর ১৯৮৭ সালে বিশ্বর ২৩টি রাষ্ট্র মাদক প্রতিরোধ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগদান করে। মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ইরানে ৩১ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে ঢাকার তেজগাওয়ে স্থাপিত মাদক চিকিৎসা কেন্দ্র কাজ করছে। খুলনা রাজশাহী ও চট্টগ্রামে আরও তিনটি মাদক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
মাদকের নেশা দ্রুত প্রসারের কারণ
সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রায় ক্ষেত্রে হতাশা ও দুঃখবোধ থেকে সাময়িক শান্তিলাভের আশা থেকেই এই মারাত্মক নেশা ক্রমবিস্তার লাভ করছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে অনেক দেশে বিপথগামী মানুষ ও বহুজাতিক সংস্থা উৎকট অর্থলালসায় বেছে নিয়েছে রমরমা মাদক ব্যবসায়ের পথ। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে বিভিন্ন দেশের মাফিয়া চক্র। মাদকের ঐ কারবারিরা সারা বিশ্বে তাদের ব্যবসায়িক ও হীনস্বার্থ রক্ষায় এই নেশা পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
উপসংহার
মাদকাসক্তি বর্তমান বিশ্বের সর্বত্রই একটি প্রধান সমস্যা। এটা আমাদের দেশের তরুণ সমাজকে গ্রাস করেছে এবং অনেককে ইতোমধ্যে বিপথগামী করেছে। কাজেই অবিলম্বে এর প্রতিকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।
1 Comment
Ata koto word er??