বিজয় দিবস
সূচনা
১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয় এবং এ দিনটি আমাদের প্রাণের রক্তেও অভিষিক্ত। ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তাই বাঙালির জাতীয় জীবনে বিজয় দিবস পাল রক্তে রাঙানো। এ দিবসে বাঙালি জাতির যুগ যুগান্তরের পরাধীনতার গ্লানি অপনোদনের এবং বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনার শুভগ্ন। ১৬ ডিসেম্বর ঘুরে ঘুরে আমাদের দ্বারে প্রতি বছর উপস্থিত হয়। আমরা পিছন ফিরে অতীত ইতিহাস দেখি।
পটভূমি
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পর ঔপনিবেশিক পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর অভিযানের মুখে যারা বাংলাদেশ এক দুঃস্বপ্নের সাগরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। ত্রিশ লক্ষ নর নারী হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল ইজ্জত হারিয়েছিল দুই লক্ষ মা বোন। খালে বিলে নদী নালায় কত মুক্তিসেনার বুকের রক্ত মিশে গেছে লাশের পর লাশ স্তূপীকৃত হয়ে কত বধ্যভূমি রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ২৫ মার্চের ভয়ঙ্কর কালো রাতের অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে দীর্ঘ নয় মাসের শ্বাসরুদ্ধকর দুঃস্বপ্নের পর ১৬ ডিসেম্বর সেই কোটি হৃদয়ের কামনার ধন স্বাধীনতার রক্ত রঙিন পতাকা বিজয়ের গৌরবে উড্ডীন হয়েছে। তাই ১৬ ডিসেম্বর একটা মামুলি জাতীয় দিবস নয়। এর সাথে জড়িত রয়েছে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার গণতান্ত্রিক চেতনা শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও মহত্তের মহিমা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে আমাদের দ্বারে সমাগত হলে আমরা তাই আমূল আলোড়িত হই এবং আত্মস হয়ে আগামী দিনের দেশ গঠনের সংগ্রামে শপথ গ্রহণ করি।
আত্মসমীক্ষা
১৯৭১ সাল থেকে ২০১০ সাল। এই দীর্ঘ ঊনচল্লিশ বছরের পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালি জাতির জীবনে কতটুকু তাৎপর্য দান করেছে এটা আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। কোনরূপ বিতর্কে না গিয়ে আমরা বিশ্বজনীন আবেদনে সাড়া দিয়ে শুধু স্বাধীনতার মৌল প্রশ্নে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করি। যে মহান আদর্শ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল দীর্ঘ নয় মাস রক্তঢালা প্রচণ্ড মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল তা আজ স্বাধীনতা লাভের ঊনচল্লিশ বছর পর কতটুকু কার্যকরী ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে তা আমাদের হিসেবে করে দেখতে হবে।
জনগণের চেতনা
জনগণ সচেতন না হলে দেশের কোন উন্নয়ন কর্মই ফলপ্রসূ হতে পারে না। আজ গ্রামা থেকে শহর-বন্দর পার হয়ে। রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত একই চেতনা একই লক্ষ্য ও অভিন্ন কর্মসূচি প্রবাহিত না হলে জাতীয় ঐক্য রক্ষা করা সুকঠিন। বাংলাদেশকে মুষ্টিমেয় ধনিক বণিক ও চাটুকার রাজনীতিকদের খাস তালুক বানাবার নীল নকশায় আনা হলে স্বাধীনতার কোন রকম আস্বাদ গ্রহণ সাধারণের পক্ষে সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের বিজয় দিবস
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এই দিনে বাঙালি জাতি অর্জন করেছে পূর্ণাঙ্গ বিজয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল। ৩০ লক্ষ শহিদের জীবন উৎসর্গ অগণিত মা বোনের সম্ভ্রমহানি এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৭১ এর এই দিনে পৃথিবীর মনচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। তাই বিজয়ের এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে সর্বাপেক্ষা স্মরণীয়, আনন্দময় এবং গৌরবের দিন।
ঐতিহাসিক পটভূমি
প্রায় দুই শত বছর শোষণের পর ১৯৪৭ সালে তীব্র আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশের দখলদারিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত এই দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলমান অধ্যুষিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মূলত দু টি আলাদা ভূ খন্ডে বিভক্ত ছিল। একটি অংশ হলো পশ্চিম পাকিস্তান এবং অন্যটি আমাদের বাংলাদেশ তৎকালীন সময়ে যার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেশ হওয়া সত্ত্বেও শুরু থেকেই গোটা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম অফিস আদালত সবকিছু পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। মোটকথা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কোনো ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা দেয়নি। ফলে সঙ্গত কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তিলাভের ইচ্ছা জাগে। ১৯৫২ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে বাঙালির মনে স্বাধীনতার গোপন ইচ্ছা তীব্রতর রূপ লাভ করে। মূলত ৫২ র এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটেছিল। ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ৬৬ এর ছয় দফা এবং ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত মজবুত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করে বাঙালিরা তাদের আকাক্সক্ষার রূপদানের স্বপ্ন দেখলেও পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের শোষণের কারণে তা অবাস্তবই থেকে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা না দিয়ে বরং দমন পীড়নের পথ বেছে নেয়। এরই প্রতিবাদে বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাঙালির আপামর জনসাধারণের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ডাক দেন। ২৫ মার্চ রাতেই মেজর জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজধানীর ঘুমন্ত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালায়। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা রাজারবাগ পুলিশ লাইন প্রভৃতি স্থানে পাক সেনারা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এরপর ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। কৃষক শ্রমিক ছাত্র শিক্ষক শিল্পী সাহিত্যিক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এদেশের সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অবশেষে ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যার জন্য আপামর জনসাধারণ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করেছিল। ঐদিন রেসকোর্স ময়দানে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এবং সূচনা ঘটে বাংলাদেশের মহান বিজয় জন্ম হয় একটি স্বাধীন দেশের যার নাম বাংলাদেশ।
৭১ এর বিজয়োল্লাস
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বাঙালির বহু ত্যাগ তিতীক্ষা ও সাধনার ফল। ৭ কোটি বাঙালির মহা উৎসবের দিন ছিল সেটি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দুঃসহ স্মৃতি স্বজন হারানোর বেদনা সবকিছু ভুলে মনুষ দলে দলে নেমে এসেছিল রাজপথে। সবার হাতে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা।দুর্বিষহ অতীতকে ভুলে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল সম্ভাবনাময় আগামীর বাংলাদেশের। বাঙালির জাতীয় জীবনে এর থেকে আনন্দের দিন আর নেই।
বাঙালির বিজয়োৎসব
১৫ ডিসেম্বর রাত ১২.০১ মিনিট থেকে বাঙালির বিজয়োৎসব শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী লাখো শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের জনগণ সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে মিলিত হয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এ দিনে সরকারি ছুটি পালিত হয়। এদিন জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের সকল সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর অংশগ্রহণে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ অসংখ্য মানুষ এ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। বিজয় দিবসের এ দিনে সারাদেশের সমস্ত স্কুল কলেজ ঘর বাড়ি দোকান পাট ও যানবাহনের লাল সবুজ পতাকা দেখা যায়। দিনব্যাপী টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। সারাদেশের সকল মসজিদ মন্দির গীর্জা প্যাগোডায় মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও প্রার্থনা করা হয়। মোটকথা দেশের প্রতি জেলায় প্রতি ঘরে ঘরে বিজয়ের এ দিনটি আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করা হয়।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য
স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবময় বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বিশ্বের দরবারে স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করেছে। বাঙালির জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের তাৎপর্য অনস্বীকার্য। প্রতি বছর বিজয় দিবস উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্ম মক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এরই ফলশ্রুতিতে তারা স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাস ঐতিহ্য ভাষা সংস্কৃতি প্রভৃতি নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে যা বিশ্বের কাছে জাতি হিসেবে বাঙালির মান মর্যাদা আরো বাড়িয়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির এক চেতনার নাম। আর বিজয় দিবস সেই চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছে কোটি বাঙালির প্রাণে। ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে অন্যায়, অবিচার শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে হয়। প্রতি বছর বিজয় দিবস আমাদের মনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রেরণা দিয়ে যায়। তরুণ প্রজন্মের উচিত লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
জাতীয় কর্তব্য
বাঙালি হিসেবে প্রত্যেকেরই এ দিনটির প্রতি কিছু কর্তব্য রয়েছে। কেবল বিজয় দিবসের একটি দিনেই নয় বরং বিজয়ের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রত্যেক বাঙালির উচিত সারা বছরই দেশ জাতি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের পক্ষে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কাজ করে যাওয়া। বিজয় দিবসের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ ও প্রচারে জাতীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয়ের ইতিহাস বিকৃত করে পরবর্তী প্রজন্মকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে সচেষ্ট তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া বাঙালির জাতীয় কর্তব্য।
বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট
প্রতিটি স্বাধীন জাতির স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত নানান ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আবেগ। তেমনই আমাদের বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপটে রয়েছে বিপুল ত্যাগ ও সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। সে ইতিহাসের এক গৌরবময় মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। পরে দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী জঙ্গিবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম। এ পটভূমিতেই ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন স্বাধীনতা।পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বীর বাঙালি। শুরু হয় এ দেশে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে মুক্তিসেনাদের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি জীবন বিসর্জন দেয়। অবশেষে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় সূচিত হয়। এই দিনে ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ঘটে ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় ঘটনা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাথা নিচু করে অস্ত্র মাটিতে ফেলে আত্মসমর্পণ করে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে।
অনুষ্ঠানমালা
বিজয় দিবস উদযাপিত হয় মহাসমারােহে। এ দিন সারাদেশ ছেয়ে যায় লাল সবুজের সাজে। বাড়ির ছাদে দোকানে রাস্তার পাশে গাড়ির সামনে স্কুল কলেজে এমনকি রিকশার হ্যান্ডেলেও শােভা পায় লাল সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা। প্রতিটি শহরে পরিলক্ষিত হয় উৎসবের আমেজ। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী আয়ােজন করে গণমুখী নানা অনুষ্ঠানের। স্বাধীনতার আবেগে উদ্বেলিত নরনারী উৎসবের সাজে সেজে সেখানে জমায়েত হন। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নানারকম অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে।এইদিন সকালবেলা ঢাকার জাতীয় প্যারেডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কূটনীতিবিদ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষ এই কুচকাওয়াজ উপভােগ করেন। চট্টগ্রাম এবং তার আশেপাশের এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার মানুষ এই মেলা দেখতে আসেন। দেশের প্রতিটি জেলায়ও উৎসবমুখর পরিবেশে এই দিনটি পালিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয় পরবর্তী বাস্তবতা ও আমাদের প্রত্যাশা
শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলেও আমাদের স্বপ্ন সম্ভাবনা বাস্তবের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে। ১৯৭৫ এ ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে জাতির জনকের মর্মান্তিক মুত্যুর মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ হয় পরিত্যক্ত। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র হয় নির্বাসিত। প্রায় দেড় দশক জুড়ে নতুন করে সংগ্রাম করতে হয়েছে গণতন্ত্রের জন্যে। আদর্শিকভাবে স্বাধীনতার মূল চেতনার অনেক কিছুই এখন অধরা। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে এখনও পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন এখনও স্বপ্ন মাত্র। জাতীয় জীবনে ঐক্যের বদলে সংঘাত সুস্থিতির বদলে অস্থিরতা শান্তির বদলে নৈরাজ্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
বিজয় দিবস উদ্যাপন
প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর চরম উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সারা দেশে পালিত হয় মহান বিজয় দিবস। এদিন সারা দেশে সরকারি ভবনসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। সারা দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। পত্রপত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। টিভি ও রেডিও চ্যানেলগুলো প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এভাবে সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে বিজয় দিবস হয়ে ওঠে উৎসবের দিন।
বিজয় দিবসের চেতনা
বিজয় দিবস আমাদের দেশপ্রেমকে শাণিত করে। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে লড়াই করার প্রেরণা পাই। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিজেদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হই। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে শিখি এই দিনে।
উপসংহার
সরকারি বেসরকারি রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সকল মহলের কাছে আমাদের আরজ বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা সংকটে বিভেদবিসম্বাদ ভুলে স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণকে সচেতন ও শ্রমশীল করার জন্য এবং স্বাধীনতার আদর্শ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পুরাপুরি অর্জনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পথের জঞ্জাল সরিয়ে দেশ গঠনে ও সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যৎ রচনার সংগ্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শান্তি ও সুখ সমৃদ্ধির জন্য একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের মহতী চেতনা আবার জাগরিত করে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
আরো দেখুন (প্রবন্ধ রচনা) :
- রচনা : বিজয় দিবস (প্রতিযোগিতার উপযোগী) – (Visit : MAG)
- রচনা : স্বাধীনতা দিবস (প্রতিযোগিতার উপযোগী) – PDF – (Visit : MAG)
- রচনা : বিজয় দিবস – (Visit : MAG)
- অনুচ্ছেদ : বিজয় দিবস – (Visit : MAG)
3 Comments
Rochonata onek sundor vabe sajano
tnx vaia
Nice and it is so helpful