স্বদেশপ্রেম
ভূমিকা
স্বদেশের প্রতি ভালবাসা মানুষের জন্মগত ও সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ যে স্থানে জন্মগ্রহণ করে লালিত পালিত হয় সেটাই তার স্বদেশ। মায়ের বুক সন্তানের যেমন নিশ্চিন্ত আশ্রয় তেমনি স্বদেশের কোলে আশ্রয় নিয়ে মানুষ নিজের অবস্থানকে নিশ্চিত করে। তাই স্বদেশের রূপ প্রকৃতি তার পশুপাখি এমনকি প্রতিটি ধূলিকণা তার কাছে প্রিয়।
স্বদেশপ্রেম কী
স্বদেশপ্রেম বলতে নিজের দেশকে ভালোবাসা বোঝায়। নিজ দেশ ও জাতির প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুরাগ ও আনুগত্যকেই বলা হয় স্বদেশপ্রেম। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার কারণেই আমরা জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে উদ্যত হই।
স্বদেশপ্রেমের প্রয়োজনীয়তা
স্বদেশপ্রেমের পূর্ণতা দেশ ও দেশের মানুষের সেবার মধ্যে। দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক যদি দেশের কল্যাণ ও গৌরবের কথা স্মরণ করে কাজ করে তবেই দেশ উন্নত হবে। আর দেশ উন্নত হলেই সকল নাগরিক সুখী সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করতে পারবে। স্বদেশপ্রেম হচ্ছে এক ধরনের নৈতিক শক্তি যা প্রত্যেকটি কাজে উৎসাহ উদ্দীপনা সঞ্চার করে। দেশপ্রেমিক দেশকে দেশের মাটি ও মানুষকে ভালবাসে। তাই স্বদেশপ্রেম সকল প্রকার হিংসা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে।
দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। আমাদের মহানবি (স)-এর তাঁর জন্মভূমি মক্কার প্রতি ছিল অগাধ মমত্ববোধ। দেশপ্রেমের জন্য চীনারা জগদ্বিখ্যাত। ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়ন এবং মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের মানুষ দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছে। আমাদের দেশের কয়েকজন খ্যাতিমান ব্যক্তি নিজের দেশ ও দেশের মানুষকে সমরত্ব লাভ করেছেন। তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
স্বদেশপ্রেমের উৎস
প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দেশকে ভালোবাসে। সকল জীবের মধ্যেই এ গুণ বিদ্যমান। বন্যপশুকে বনভূমি ছেড়ে লোকালয়ে আনলে পাখিকে নীড়চ্যুত করলে তারা আর্তনাদ শুরু করে। এটি করে নিজ আবাসস্থানের প্রতি ভালোবাসার টানে। নিজ আবাসের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা। স্বদেশের মাটি পানি আলো বাতাস যেন আমাদের জীবনেরই অঙ্গ। এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গহানির শামিল। এগুলোর প্রতি মমত্ববোধ থেকেই সৃষ্টি হয় স্বদেশপ্রেম। দেশের মাটির প্রতি মমত্ববোধের সাথে মিশে থাকে শ্রদ্ধা প্রীতি ও গৌরববোধের আকাঙ্ক্ষা।
স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ
মানুষ সমগ্র বিশ্বের বাসিন্দা হলেও একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সে বেড়ে উঠে। একটি বিশেষ দেশের অধিবাসী হিসেবে সে পরিচয় লাভ করে। এ দেশই তার জন্মভূমি তার স্বদেশ। মানুষ স্বদেশে জন্মগ্রহণ করে ও স্বদেশের ভালোবাসায় লালিত পালিত হয়। নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সকল উপাদান সে স্বদেশ থেকে পায়। ফলে স্বদেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এ জন্য মানুষ স্বদেশের গৌরবে গৌরবান্বিত হয় এবং স্বদেশের অপমানে অপমাণিত হয়। স্বদেশের স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। কবি ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত তাই লিখেছেন-
মিছা মনিমুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাই আর।
স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ
স্বদেশপ্রেম মানব হৃদয়ে লালিত হয়। আর স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায় জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে মানুষের কর্মের মাধ্যমে। স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় স্বদেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে মানুষের মনে স্বদেশপ্রেম জেগে ওঠে। যাঁরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন তাদের নাম ও কীর্তি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁদের সে প্রেম ও আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে চিরকাল। স্বদেশের তরে জীবন উৎসর্গকারীরা সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়-
ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
দেশপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ
কেবল দেশকে ভালোবাসার মধ্যে দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ নয়। দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে নেওয়া যেমন শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান অর্থনীতি সমাজনীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে অবদান রাখাও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সম্প্রতি ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা গাইতে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন মানুষের একত্রিত হওয়া দেশপ্রেমরই বহিঃপ্রকাশ। দেশের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে বিশ্বসভ্যতায় গৌরব বাড়ানো যায়। রবীন্দ্রনাথ নজরুল ড. মুহাম্মদ ইউনুস সাকিব আল হাসান প্রমুখের গৌরবময় অবদানের জন্য বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ আমরা নবী করীম (স.) এর মধ্যে দেখতে পাই দেশকে ভালোবেসে তিনি বলেছিলেন-
হে মাতৃভূমি তোমার লোকেরা যদি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করত তবে আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম
স্বদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্বদেশপ্রেম কখনও বিশ্বপ্রেমের বাধা হয় না। দেশপ্রেম যদি বিশ্ববন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই দেশপ্রেমের চেতনায় উৎসাহিত হতে হবে। যে নিজের দেশকে ভালোবাসে না সে অন্য দেশ ভাষা গোষ্ঠী তথা মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না। তাই দেশপ্রেমের মধ্যেই বিশ্বপ্রেমের প্রকাশ ঘটে।
সাহিত্যের আয়নায় দেশপ্রেম
বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাদের কবিতা কাব্য নাটক গান উপন্যাস প্রভৃতি লেখনির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমল থেকেই। নীলদর্পণ আনন্দমঠ মেঘনাদ বধ প্রভৃতি গ্রন্থে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। এছাড়া নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে।
ছাত্রজীবনে স্বদেশ প্রেমের শিক্ষা
স্বদেশপ্রেম মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলেও এ গুণটি তাকে অর্জন করতে হয়। তাই ছাত্রজীবন থেকেই দেশপ্রেমের দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে হবে। ছাত্রজীবনে যে দেশপ্রেম মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় তা মনে আজন্ম লালিত হয়। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশের ভালো মন্দ তাদের উপর অর্পিত হবে। সবার আগে দেশের বিপদে আপদে ও প্রয়োজনে ছাত্রদেরকেই এগিয়ে আসেত হবে। প্রয়োজনে দেশের স্বার্থে ছাত্রদেরকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। যেমনটি ছাত্ররা করেছিল ১৯৫২ সালের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করে।
স্বদেশপ্রেমের প্রভাব
স্বদেশেপ্রেমের মহৎ চেতনায় মানব চরিত্রের সৎ গুণাবলি বিকশিত হয়। মানুষের মন থেকে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা দূর হয়। স্বদেশপ্রেম মানুষকে উদার ও মহৎ করে পরার্থে জীবন উৎসর্গ করতে প্রেরণা দেয়। স্বদেশপ্রেমের কারণেই মানুষ আত্মসুখ ত্যাগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণ করে ভালোবাসো।
বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি ও দেশপ্রেম
নগর কেন্দ্রীক সভ্যতায় মানুষ তার পাশের বাড়ির মানুষের কথাই ভুলে গেছে। মানুষ আজ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। দেশের মানুষের চিন্তা করার মানসিকতা তার নেই। মানুষের মধ্যে বাঁচার তাগিদ আজ আর কেউ অনুভব করে না। কেননা মানুষের মধ্যে বাঁচা মানে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বাঁচা। কিন্তু সবাই এখন নিজের জন্য বাঁচতে চায়। তাই দেশ ও জাতির জন্য আমাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
উগ্র দেশপ্রেম
দেশপ্রেম দেশ ও জাতির জন্য গৌরবের। কিন্তু উগ্র দেশপ্রেম ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুটি বিশ্বযুদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা উগ্র দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তা ও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তাই উগ্র দেশপ্রেম সব সময় অশুভ চির অকল্যাণকর ও চির অশান্তির।
উপসংহার
দেশপ্রেম মানুষের একটি বিশেষ গুণ। নিজের দেশকে ভালবাসতে পারলেই বিশ্বের সকল মানুষকে ভালবাসা সম্ভব। তাই স্বদেশপ্রেম মানবপ্রেমেরই একটি রূপ।