Tag Archives: বাংলাদেশ

রচনা : স্বদেশপ্রেম [15 পয়েন্ট]

স্বদেশপ্রেম

ভূমিকা

স্বদেশের প্রতি ভালবাসা মানুষের জন্মগত ও সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ যে স্থানে জন্মগ্রহণ করে লালিত পালিত হয় সেটাই তার স্বদেশ। মায়ের বুক সন্তানের যেমন নিশ্চিন্ত আশ্রয় তেমনি স্বদেশের কোলে আশ্রয় নিয়ে মানুষ নিজের অবস্থানকে নিশ্চিত করে। তাই স্বদেশের রূপ প্রকৃতি তার পশুপাখি এমনকি প্রতিটি ধূলিকণা তার কাছে প্রিয়।

 

স্বদেশপ্রেম কী

স্বদেশপ্রেম বলতে নিজের দেশকে ভালোবাসা বোঝায়। নিজ দেশ ও জাতির প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুরাগ ও আনুগত্যকেই বলা হয় স্বদেশপ্রেম। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার কারণেই আমরা জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে উদ্যত হই।

 

স্বদেশপ্রেমের প্রয়োজনীয়তা

স্বদেশপ্রেমের পূর্ণতা দেশ ও দেশের মানুষের সেবার মধ্যে। দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক যদি দেশের কল্যাণ ও গৌরবের কথা স্মরণ করে কাজ করে তবেই দেশ উন্নত হবে। আর দেশ উন্নত হলেই সকল নাগরিক সুখী সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করতে পারবে। স্বদেশপ্রেম হচ্ছে এক ধরনের নৈতিক শক্তি যা প্রত্যেকটি কাজে উৎসাহ উদ্দীপনা সঞ্চার করে। দেশপ্রেমিক দেশকে দেশের মাটি ও মানুষকে ভালবাসে। তাই স্বদেশপ্রেম সকল প্রকার হিংসা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে।

 

দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। আমাদের মহানবি (স)-এর তাঁর জন্মভূমি মক্কার প্রতি ছিল অগাধ মমত্ববোধ। দেশপ্রেমের জন্য চীনারা জগদ্বিখ্যাত। ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়ন এবং মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের মানুষ দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছে। আমাদের দেশের কয়েকজন খ্যাতিমান ব্যক্তি নিজের দেশ ও দেশের মানুষকে সমরত্ব লাভ করেছেন। তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

 

স্বদেশপ্রেমের উৎস

প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দেশকে ভালোবাসে। সকল জীবের মধ্যেই এ গুণ বিদ্যমান। বন্যপশুকে বনভূমি ছেড়ে লোকালয়ে আনলে পাখিকে নীড়চ্যুত করলে তারা আর্তনাদ শুরু করে। এটি করে নিজ আবাসস্থানের প্রতি ভালোবাসার টানে। নিজ আবাসের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা। স্বদেশের মাটি পানি আলো বাতাস যেন আমাদের জীবনেরই অঙ্গ। এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গহানির শামিল। এগুলোর প্রতি মমত্ববোধ থেকেই সৃষ্টি হয় স্বদেশপ্রেম। দেশের মাটির প্রতি মমত্ববোধের সাথে মিশে থাকে শ্রদ্ধা প্রীতি ও গৌরববোধের আকাঙ্ক্ষা।

 

স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ

মানুষ সমগ্র বিশ্বের বাসিন্দা হলেও একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সে বেড়ে উঠে। একটি বিশেষ দেশের অধিবাসী হিসেবে সে পরিচয় লাভ করে। এ দেশই তার জন্মভূমি তার স্বদেশ। মানুষ স্বদেশে জন্মগ্রহণ করে ও স্বদেশের ভালোবাসায় লালিত পালিত হয়। নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সকল উপাদান সে স্বদেশ থেকে পায়। ফলে স্বদেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এ জন্য মানুষ স্বদেশের গৌরবে গৌরবান্বিত হয় এবং স্বদেশের অপমানে অপমাণিত হয়। স্বদেশের স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। কবি ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত তাই লিখেছেন-

মিছা মনিমুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাই আর।

 

স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ

স্বদেশপ্রেম মানব হৃদয়ে লালিত হয়। আর স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায় জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে মানুষের কর্মের মাধ্যমে। স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় স্বদেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে মানুষের মনে স্বদেশপ্রেম জেগে ওঠে। যাঁরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন তাদের নাম ও কীর্তি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁদের সে প্রেম ও আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে চিরকাল। স্বদেশের তরে জীবন উৎসর্গকারীরা সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়-

ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।

 

দেশপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ

কেবল দেশকে ভালোবাসার মধ্যে দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ নয়। দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে নেওয়া যেমন শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান অর্থনীতি সমাজনীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে অবদান রাখাও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সম্প্রতি ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা গাইতে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন মানুষের একত্রিত হওয়া দেশপ্রেমরই বহিঃপ্রকাশ। দেশের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে বিশ্বসভ্যতায় গৌরব বাড়ানো যায়। রবীন্দ্রনাথ নজরুল ড. মুহাম্মদ ইউনুস সাকিব আল হাসান প্রমুখের গৌরবময় অবদানের জন্য বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ আমরা নবী করীম (স.) এর মধ্যে দেখতে পাই দেশকে ভালোবেসে তিনি বলেছিলেন-

হে মাতৃভূমি তোমার লোকেরা যদি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করত তবে আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।

 

স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম

স্বদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্বদেশপ্রেম কখনও বিশ্বপ্রেমের বাধা হয় না। দেশপ্রেম যদি বিশ্ববন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই দেশপ্রেমের চেতনায় উৎসাহিত হতে হবে। যে নিজের দেশকে ভালোবাসে না সে অন্য দেশ ভাষা গোষ্ঠী তথা মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না। তাই দেশপ্রেমের মধ্যেই বিশ্বপ্রেমের প্রকাশ ঘটে।

 

সাহিত্যের আয়নায় দেশপ্রেম

বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাদের কবিতা কাব্য নাটক গান উপন্যাস প্রভৃতি লেখনির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমল থেকেই। নীলদর্পণ আনন্দমঠ মেঘনাদ বধ প্রভৃতি গ্রন্থে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। এছাড়া নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে।

 

ছাত্রজীবনে স্বদেশ প্রেমের শিক্ষা

স্বদেশপ্রেম মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলেও এ গুণটি তাকে অর্জন করতে হয়। তাই ছাত্রজীবন থেকেই দেশপ্রেমের দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে হবে। ছাত্রজীবনে যে দেশপ্রেম মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় তা মনে আজন্ম লালিত হয়। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশের ভালো মন্দ তাদের উপর অর্পিত হবে। সবার আগে দেশের বিপদে আপদে ও প্রয়োজনে ছাত্রদেরকেই এগিয়ে আসেত হবে। প্রয়োজনে দেশের স্বার্থে ছাত্রদেরকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। যেমনটি ছাত্ররা করেছিল ১৯৫২ সালের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করে।

 

স্বদেশপ্রেমের প্রভাব

স্বদেশেপ্রেমের মহৎ চেতনায় মানব চরিত্রের সৎ গুণাবলি বিকশিত হয়। মানুষের মন থেকে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা দূর হয়। স্বদেশপ্রেম মানুষকে উদার ও মহৎ করে পরার্থে জীবন উৎসর্গ করতে প্রেরণা দেয়। স্বদেশপ্রেমের কারণেই মানুষ আত্মসুখ ত্যাগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণ করে ভালোবাসো।

 

বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি ও দেশপ্রেম

নগর কেন্দ্রীক সভ্যতায় মানুষ তার পাশের বাড়ির মানুষের কথাই ভুলে গেছে। মানুষ আজ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। দেশের মানুষের চিন্তা করার মানসিকতা তার নেই। মানুষের মধ্যে বাঁচার তাগিদ আজ আর কেউ অনুভব করে না। কেননা মানুষের মধ্যে বাঁচা মানে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বাঁচা। কিন্তু সবাই এখন নিজের জন্য বাঁচতে চায়। তাই দেশ ও জাতির জন্য আমাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

 

উগ্র দেশপ্রেম

দেশপ্রেম দেশ ও জাতির জন্য গৌরবের। কিন্তু উগ্র দেশপ্রেম ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুটি বিশ্বযুদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা উগ্র দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তা ও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তাই উগ্র দেশপ্রেম সব সময় অশুভ চির অকল্যাণকর ও চির অশান্তির।

 

উপসংহার

দেশপ্রেম মানুষের একটি বিশেষ গুণ। নিজের দেশকে ভালবাসতে পারলেই বিশ্বের সকল মানুষকে ভালবাসা সম্ভব। তাই স্বদেশপ্রেম মানবপ্রেমেরই একটি রূপ।


রচনা : বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প [19 পয়েন্ট] – PDF

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প

ভূমিকা

বাংলাদেশ প্রকৃতির নন্দনকাননের সৌন্দর্যমণ্ডিত কোনাে সার্থক চিত্রশিল্পীর নিখুঁত চিত্রকর্মের সঙ্গে তুলনীয়। বদ্বীপ সদৃশ এ বঙ্গভূমির রয়েছে বিচিত্র ভূ ভাগ এবং সমুদ্র শুনিত বিস্তীর্ণ উপকূল। সমুদ্র তটরেখা ও ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন যা বিদেশি পর্যটকসহ দেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এদেশে পর্যটন শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে আছে সমান্তরাল ভূমি পাহাড় পর্বত জলপ্রপাত চা বাগানের আহামরি দৃশ্য সবুজ গালিচার মতাে শস্য ক্ষেত মাঠ প্রান্তর। আর বিশেষ করে মাকড়সার জালের মতাে ছড়িয়ে আছে রূপালি সব ছােটবড় নদী। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন আকর্ষণের অভাব নেই। শুধু দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।

 

পর্যটনের সংজ্ঞা

অল্প কথায় বা নির্দিষ্ট কিছু মানদন্ডের আলোকে পর্যটনকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। কারণ একেকজনের দৃষ্টিতে পর্যটন একেক রকম। সহজ কথায় পার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যে মানুষের দর্শনীয় স্থানে অবস্থান এবং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত কর্মকা কে পর্যটন বলে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে যখন অর্থনীতি আলাদা একটি গতি পায় তখন তাকে বলে পর্যটন শিল্প। আন্তর্জাতিক পর্যটন বিশেষজ্ঞ সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী পর্যটন হলো কোনো উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত নয় এবং স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে না এমন ব্যক্তির ভ্রমণ এবং কোথাও থাকা থেকে উৎসারিত প্রপঞ্চ এবং সম্পর্কের সমষ্টি।

 

পর্যটনের ধারণা

মানুষ কখনােই এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না পথ চলাতেই তার আনন্দ। দেশ দেশান্তরে পরিভ্রমণ করে মানুষ তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য পিপাসাকে নিবৃত্ত করে। এ পরিভ্রমণকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে পর্যটন শিল্প। মানুষের একে অপরকে জানার আগ্রহ থেকেই পর্যটনের বিকাশ ঘটেছে। হয়ত পর্যটনের নামে নয় কিন্তু পর্যটন বিষয়টি অনেক পুরাতন। মার্কোপােলাে ইবনে বতুতা ভাস্কো দা গামা কলম্বাস ক্যাপ্টেন কুক ফা হিয়েন হিউয়েন সাং সহ বিশ্ববিখ্যাত পর্যটকরা ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে আছেন। সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য কেউ কেউ অজানা ভূখণ্ডকে আবিষ্কারের জন্য ভয়কে তুচ্ছ করে দেশ পর্যটন করেছেন পাড়ি জমিয়েছেন অজানার পথ। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে অচেনা পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন বলেই অনেক অজানা পাহাড় পর্বত মরুভূমি মেরুদেশ কিংবা অনেক ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার সন্ধান পেয়েছিলেন। এসব কাহিনি পড়ে আজ মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডার পূর্ণ হচ্ছে মানবসভ্যতা হচ্ছে সমৃদ্ধ।

 

শিল্প হিসেবে পর্যটন

অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার অদেখাকে দেখার আকাক্ষায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করাকে পর্যটন বলা হয়। বর্তমানে পর্যটন শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও বিভিন্ন কারণে এদেশের পর্যটন শিল্পকে প্রকৃত শিল্প হিসেবে গড়ে তােলা যায়নি। তবে পর্যটন শিল্পের জন্য প্রয়ােজনীয় সকল উপাদানই বাংলাদেশে পুরােপুরি বিদ্যমান। অবকাঠামােগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে পুরােপুরি শিল্পর মর্যাদায় উন্নতি করা যায়। আর তা সম্ভব হলে বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের পদভারে বাংলাদেশ মুখরিত হয়ে উঠবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

 

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশ একটি সুপ্রাচীন দেশ। প্রাচীনত্বের গরিমায় বাংলা সারা বিশ্বে পরিচিত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজরাজাদের পৃষ্ঠপােষকতায় এ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দারুণভাবে উন্নতি লাভ করেছে। আমরা জানি খ্রিস্টপূর্বকালে বিশ্ব জয় করেছিল বাংলার মসলিন। পৃথিবীব্যাপী এদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সােনারগাঁও এ তৈরি সূক্ষ্ম বস্ত্র মসলিনের মাধ্যমে। দেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ইতিহাস বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে দেশের জন্য আর্থিক সমৃদ্ধি আনয়ন করেছে। বর্তমানে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা বর্তমান। এছাড়াও পৃথিবীর সবচেয়ে বড়াে ম্যানগ্রোভ বন (সুন্দরবন) রয়েছে বাংলাদেশে যা বিশ্ববাসীর মনােযােগ আকর্ষণে রাখতে পারে ব্যাপক ভূমিকা। আমাদের রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত যা অবিচ্ছিন্নভাবে ১২০ কিলােমিটার দীর্ঘ। আরাে একটি কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে গৌরবজনক আসন অলংকৃত করে আছে তা একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বস্তুত ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটি যেন প্রাকৃতিক এক মিউজিয়াম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উপমহাদেশের এ দেশটি তাই মন মাতানাে দৃষ্টিনন্দন এবং কবি লেখক তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। চোখ জুড়ানাে মন ভুলানাে এ দেশ আমার আপনার গর্ব। এর সৌন্দর্যে বিভাের হয়ে কবি পেয়েছে ভাষা মানুষ পেয়েছে আশা। পর্যটক চোখ খুলে মন ভরে উপভােগ করে এর সৌন্দর্য মেটায় অন্তরের তৃষ্ণা ভ্রমণের মাধ্যমে। তাইতাে কবি বলেন

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।

নদীর বুকে ভেসে থাকা রং বেরঙের পাল তােলা সারিসারি নৌকা মণ প্রাণকে দোলা দেয়। ছােটবড় ঢেউ এবং কখনাে নিস্তরঙ্গ পানির উপর দিয়ে ভেসে থাকা যন্ত্রচালিত জলযান লঞ্চ স্টিমারের যাতায়াত দর্শনার্থী মানুষের মনে জাগায় পুলক। বাংলার এই রূপে মুগ্ধ হয়েই কবি গেয়েছেন-

আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে থাকে সারা মন
শ্যামল কোমল পরশ ছড়ায় নেই কিছু প্রয়ােজন।

ছয় ঋতুর এ দেশে কত রুপ কত গান তা দেখে উদাস পথিকের তেষ্টা মেটে না। সবার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে গান-

আজো মা তাের মুখের হাসি হয় নি দেখা দুচোখ ভরে
আজো মা তাের গল্প আমায় হৃদয় দেহ পাগল করে।

বাংলাদেশের অনুপম নিসর্গ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পর্যটন শিল্প প্রসারের অনন্য উপাদান। এ অনুপম নৈসর্গিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উপভােগের জন্য বাংলাদেশে যুগে যুগে হাতছানি দিয়েছে কাছের ও দূরের ভ্রমণপিপাসুদের। তারা অবাক হয়ে দেখেছে এই পৃথিবীতে এমন একটি দেশ আছে যা ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা সবুজ শ্যামল প্রকৃতিময় আর আছে সুখ শান্তি সমৃদ্ধির অফুরন্ত ভাণ্ডার। অনেকেই তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় প্রশস্তি গেয়েছেন বাংলাদেশের মনোলােভা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের। এমনই একজন পর্যটকের উক্তি –

বাংলাদেশে প্রবেশের হাজার দুয়ার খােলা রয়েছে কিন্তু বেরুবার একটিও নেই।

তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যটন এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যেখানে প্রচুর বিনিয়ােগ না করেও বিপুল আয় করা সম্ভব। পর্যটনের জন্য তেমন নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হয় না। শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত উপকরণকে রূপান্তরের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করলেই চলে। পর্যটন স্পটগুলােকে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করলেই এ খাতে বিপুল আয় করা সম্ভব। বিশ্বের অনেক দেশ আছে যাদের জাতীয় আয়ের বিরাট অংশই পর্যটন খাত হতে আসে।

 

বিশ্বায়নের যুগে পর্যটন শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

পৃথিবীকে আজ আমরা গ্লোবাল ভিলেজ বলছি। অর্থাৎ সারা পৃথিবীর সব দেশ মিলেমিশে একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা ও তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের ফলে সময় এসেছে পরস্পরের কাছে পরস্পরকে মেলে ধরার। নিজের দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ভ্রমণপিপাসু বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপনের এখনই সময়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতাে বাংলাদেশেও পর্যটন শিল্প যথাযথ উন্নতি ও তদারকির মাধ্যমে লাভজনক শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। আমাদের বৈদেশিক আয়ের একটা বিশেষ উৎস পর্যটন শিল্প। বিশ্বায়নের যুগে পর্যটন একটা লাভজনক অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির মাধ্যম। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতাে বাংলাদেশেও পর্যটন শিল্পের যথাযথ উন্নতি ও তদারকিতে লাভজনক হিসেবে গড়ে ওঠতে পারে। পেট্রো ডলারের মতাে চিংড়ি ও পােশাক রপ্তানি চা চামড়া পাট যা দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামাে ধরে রাখতে এককালে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল সে তুলনায় বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে তাদের ব্যায়িত বিদেশি কারেন্সি অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

পর্যটন আজকের বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং অতিদ্রুত সম্প্রসারণশীল শিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব মতে ২০০০ সালে মােট ৬২ কোটি মানুষ বিভিন্ন দেশে পর্যটনে যায়। ২০১০ সালে পর্যটকের সংখ্যা ১০০ কোটিতে উন্নীত হবে। পর্যটকগণ প্রতিবছর থাকা খাওয়া ও সাইট সিইং বাবদ গড়ে প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার ব্যয় করে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ২৫ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এই খাত থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে এবং আগামী বছরগুলোতে এর সংখ্যা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। যা বিশ্বের মােট বিনিয়ােগের শতকরা ২৫% হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশও পর্যটনের এ শিল্প ও সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে।

 

বাংলাদেশ পর্যটন করপােরেশন

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া পর্যটন শিল্পের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রয়ােজন হয়। বাংলাদেশের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে দেশ বিদেশের পর্যটকদের কাছে তুলে ধরে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও বেকারত্ব বিমােচনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ২৭ নভেম্বর তারিখে জারিকৃত মহামান্য রাষ্ট্রপতির ১৪৩ নং আদেশ বলে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পর্যটন সম্ভাবনাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদানের উদ্যোগ সূচিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পর্যটন করপােরেশন নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করে এবং ১৯৭৫ সালে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ পর্যটন করপােরেশন নবগঠিত মন্ত্রণালয়ের অধীনে নীত হয়। জাতীয় পর্যটন সংস্থা হিসেবে এই সংস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থানসমূহের অবকাঠামাের উন্নয়ন পর্যটকদের সেবা প্রদান বিদেশে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা ও দেশের পর্যটন সম্পদের বিকাশের পাশাপাশি এ শিল্পের বিভিন্ন অঙ্গনে কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টিসহ দেশের দারিদ্র্য বিমােচনে সহায়তা করা।

 

শ্রেণীভিত্তিক বাংলাদেশের পর্যটন আকর্ষণ বাংলাদেশের পর্যটন আকর্ষণগুলােকে নিম্নরুপে ভাগ করা যায়।

যথা:

ক) প্রাকৃতিক বা বিনােদনমূলক পর্যটন

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভােগ শহরের যান্ত্রিক জীবনের বাইরে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসা কিংবা হঠাৎ করে কোনাে নতুন পরিবেশের ছোঁয়া পাবার জন্য মানুষ ছুটে যায় প্রকৃতির কাছে। এ ধরনের নয়নকাড়া প্রাকৃতিক অবস্থান বাংলাদেশে প্রচুর রয়েছে। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনােরম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল ও চা বাগান তামাবিল জাফলং রাঙামাটির নয়নাভিরাম কৃত্রিম হ্রদ সুন্দরবনসহ বিভিন্ন বনাপল। এছাড়াও রয়েছে উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চল বর্ণাঢ্য উপজাতীয় ও গ্রামীণ জীবনধারা।

 

খ) রােমাঞ্চকর ভ্রমণ এবং পরিবেশভিত্তিক পর্যটন

রােমাঞ্চকর ও পরিবেশভিত্তিক পর্যটনের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিতসম্ভার দেখা যায়। রাঙ্গামাটির নৌবিহার মৎস্য শিকার জলক্রীড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ট্রেকিং হাইকিং ইত্যাদির সুযােগ রয়েছে। সাগরের বুক চিরে অপরূপ দ্বীপ সেন্টমার্টিন। পর্যটক আকর্ষণের এমনি অনেক সুযােগ আছে আমাদের এই বাংলাদেশে।

 

গ) সাংস্কৃতিক পর্যটন

ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন সাংস্কৃতিক পর্যটনের পর্যায়ভুক্ত। মহাস্থানগড় ময়নামতি পাহাড়পুর ঢাকার লালবাগের দুর্গ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার জাতীয় স্মৃতিসৌধ জাতীয় জাদুঘর সােনারগাঁও জাদুঘর, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর নাটোর ও পুঠিয়ার রাজবাড়ি এবং এমনি আরাে অনেক সাংস্কৃতিক ও প্রত্নতাত্মিক নিদর্শন রয়েছে বাংলাদেশে।

 

ঘ) ধর্মীয় পর্যটন

বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লােকেরা মূলত ধর্মীয় অনুভূতি থেকেই কিছু কিছু স্থানে ভ্রমণ করে। ঐতিহাসিক ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আকর্ষণীয় স্থান বাংলাদেশে বিস্তর। মসজিদ মন্দির গির্জা মাজার দরগাহসহ বিভিন্ন নিদর্শন ছড়িয়ে আছে সারাদেশময়। এসব আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ ঢাকার সাতগম্বুজ মসজিদ রাজশাহীর শাহ মখদুমের মাজার পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার মহাস্থানগড় নবাবগঞ্জের সােনা মসজিদ ঢাকেশ্বরী মন্দির আর্মেনিয়ান চার্চ চট্টগ্রামের বায়েজিদ বােস্তামীর দরগাহ সিলেটের হজরত শাহজালারের দরগা কক্সবাজারের রামু মন্দির রাজশাহীর তাহেরপুর রাজবাড়ি প্রভৃতি।

 

ঙ) নৌ পর্যটন

বিনােদনমূলক পর্যটনের জন্য এদেশের নদনদী আকর্ষণীয় উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে বহুকাল যাবৎ। বাংলাদেশ নদীবহুল দেশ। ২৫৭টি ছােটবড় নদনদী জালের মতাে বিস্তৃত হয়ে আছে সারাদেশময়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃত সৌন্দর্য অনেকাংশেই ফুটে ওঠে নৌভ্রমণের মাধ্যমে। এখান থেকেই অনুভব করা যায় সােনারবাংলার প্রকৃত ছবি।

 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প নানাভাবে অবদান রাখতে পারে। প্রথমত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এ শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাংলাদেশে এমনিতেই রপ্তানি কম। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কোনাে খাতই তেমন শক্তিশালী নয়। এই প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে পর্যটনের মতাে অদৃশ্য রপ্তানি পণ্য খাতে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারে। পর্যটন করপােরেশন মুনাফা অর্জনকারী সংস্থার মধ্যে একটি। ১৯৮৩-৮৪ থেকে ২০০৩-২০০৪ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান সর্বমােট ৪৯৭৩.১০ লক্ষ টাকা করপূর্ব মুনাফা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ সরকার পর্যটন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযােগিতা ও সুনাম অর্জনে বিরাট অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ ২ বছরের জন্য (২০০১-২০০৩) বিশ্ব পর্যটন সংস্থার কমিশন ফর সাউথ এশিয়ার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশ পর্যটন করপােরেশন বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য ১৯৭৪ সালে জাতীয় হােটেল ও পর্যটন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। এ পর্যন্ত এখানে পরিচালিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে ২২,০০০-এর বেশি ছাত্র ছাত্রীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশ বিদেশ কর্মরত আছে। পর্যটন শিল্পের উন্নতির সঙ্গে যে সব ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হতে পারে সেগুলাে হল:

  1. ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি ও বেকারত্ব লাঘব
  2. প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন
  3. কুটিরশিল্প ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন
  4. বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি
  5. অবকাঠামাে ও যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন
  6. বৈদেশিক বিনিয়ােগ
  7. আন্তর্জাতিক যােগাযােগ বৃদ্ধি ইত্যাদি।

 

শিক্ষাক্ষেত্রে ও জ্ঞানার্জনে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব

মানুষ জন্মগতভাবে সৌন্দর্যপিয়াসি। স্রষ্টার অপূর্ব সব সৃষ্টি দেখার নেশায় মানুষ ঘুরে বেড়ায় দেশ হতে দেশান্তরে। পর্যটনকে বিনােদনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপকরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। শুধু তাই নয় বিনােদনের সাহায্যে শিক্ষালাভের সবচেয়ে উপযােগী মাধ্যম হচ্ছে পর্যটন। পাঠ্যপুস্তকের একটি বিষয় দশবার পড়ে যে জ্ঞানার্জন করা যায় একবার স্বচক্ষে দেখেই তার চেয়ে বেশি জ্ঞানলাভ করা সম্ভব। উন্নত অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশেই পর্যটনকে শিক্ষার উপকরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাে প্রতিবছর যে শিক্ষাসফরের আয়ােজন করে তা পর্যটন ছাড়া আর কিছু নয়। এছাড়া পর্যটকের লেখা ভ্রমণবৃত্তান্ত ইতিহাসের চমৎকার উপকরণ হিসেবে গণ্য। তাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠ করে আমরা যেকোনাে জনপদের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। পর্যটন শুধু অকারণ নেশা বা বিনােদন মাধ্যম মাত্র নয়। বিশ্বের কোনাে দেশেই এখন আর পর্যটনকে শুধু বিনােদন উপকরণ হিসেবে মানতে নারাজ। বরং সব দেশেই এখন পর্যটনকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক খাত এবং জ্ঞানার্জনের অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে।

 

আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব

সমগ্র বিশ্বের প্রায় ১১ কোটি মানুষ পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত। এ শিল্প কেবল নিজ দেশের অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করে না বরং বিশ্ব অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করে। ১৯৯১ সালের বাংলাদেশের সরকার প্রণীত পর্যটন নীতিমালায় পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প আশানুরূপ উন্নতি লাভ করতে পারেনি। অথচ অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষা সরকারি রাজস্ব আয় বৃদ্ধি প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন বৈদেশিক বিনিয়ােগ বৃদ্ধি অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি সৃষ্টি ভূমি উন্নয়নে সহায়তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ সূচনা সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। প্রয়ােজন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেরও। পর্যাপ্ত বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের কাক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।

 

পর্যটন শিল্প বিকাশে করণীয়

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এই শিল্পের বিকাশে (১) সরকারি পৃষ্ঠপােষকতায় পর্যটন স্পটগুলােকে বেশি আকর্ষণীয় করে তােলা (২) যাতায়াতের সুষ্ঠু ব্যবস্থা তথা বিমান নৌ ও সড়ক যােগাযােগের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন (৩) নিরাপদ ভ্রমণের যাবতীয় ব্যবস্থাকরণ (৪) দেশি বিদেশি পর্যটকদের জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া সচেষ্ট হতে হবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিরসনে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায়। পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য চাই প্রয়ােজনীয় অবকাঠামােগত উন্নয়ন ও সংস্কার। চাই স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা। আকর্ষণীয় এলাকাগুলাের পরিকল্পিত নান্দনিক উন্নয়ন যেমন প্রয়ােজন তেমনি প্রয়ােজন পর্যটন কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। পর্যটন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে প্রয়ােজন তথ্যপূর্ণ আকর্ষণীয় প্রচার। এই শিল্পের বিকাশের জন্য পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে পর্যটকদের নিরাপত্তা। বিভিন্ন দেশের মতাে পর্যটকদের বাড়তি কিছু সুবিধা দিতে হবে। সৈকতে রাখতে হবে বিভিন্ন বিনােদনের ব্যবস্থা ব্যবহার করতে হবে আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি। প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থানসহ অন্যান্য দৃষ্টিনন্দন স্থানকে পর্যটনের আওতায় এনে সমৃদ্ধ করতে হবে।

 

পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে পর্যটন সংস্থার দায়িত্ব

বাংলাদেশ সরকার পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে যথেষ্ট আন্তরিক সচেতন ও তৎপর। এ লক্ষ্যে সরকার বাংলাদেশ পর্যটন শিল্প সংস্থার হাতে দেশের পর্যটন শিল্পের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশ পর্যটন শিল্প সংস্থা পর্যটন শিল্পকে আধুনিকায়ন করতে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইতােমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন শিল্প সংস্থার কতকগুলাে আঞ্চলিক অফিস স্থাপন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কতকগুলাে আধুনিক অভিজাত শ্রেণির ডাকবাংলাে স্থাপিত হয়েছে। কাপ্তাই ও রাঙামাটিতে কতকগুলাে সুন্দর ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দেশি ও বিদেশি পর্যটকেরা এগুলাে ব্যবহার করে থাকেন। তাছাড়া কাপ্তাই ও রাঙামাটিতে হাউসবােট স্পিডবােট ইত্যাদি প্রমােদতরিরও ব্যবস্থা করেছে।

 

পর্যটকদের সুযােগ সুবিধা

বাংলাদেশ পর্যটন শিল্প সংস্থার অধীনে কক্সবাজার রাঙামাটি কুমিল্লা কুয়াকাটা রংপুর সিলেট প্রভৃতি স্থানে ছােট বড় অভিজাত শ্রেণির হােটেল রেস্তোরাঁ ও ক্রীড়াকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসসহ নানা ধরনের যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের নিরাপত্তার জন্য সৈকত পুলিশের ব্যবস্থাও আছে। রাঙামাটি ও কাপ্তাইয়ে হাউসবােট ও স্পিডবােটের ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার জন্য বাংলাদেশ পর্যটন শিল্প সংস্থা ট্যুরিস্ট গাইড এর ব্যবস্থা করেছে। ব্যাপক সুবিধার পাশাপাশি পর্যটনের বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। পর্যটনকে একটি শক্তিশালী মাধ্যমে হিসেবে গড়ে তুলতে হলে যে বিষয়টিকে প্রথমে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে তা হলাে পর্যটকদের চাহিদা ও নিরাপত্তা। বিশ্বের নানা দেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য আমাদের দেশের দর্শনীয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলােকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তুলতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দর্শনীয় ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলােকে সংস্কারের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে। আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থানগুলাের সাথে যােগাযােগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করতে হবে। আর সেগুলাে সম্ভব হলে বিদেশি পর্যটকদের আগমন বেড়ে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথ সুগম হবে।

 

উপসংহার

পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে আরাে উন্নত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়ােজন। ৭ম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন : A sleeping beauty emerging from mists and water. এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকে সর্বদা ধরে রাখার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশের দায়িত্ব আমাদের। সরকারের পাশাপাশি আমরা বেসরকারি উদ্যোগে বিকাশ ঘটাতে পারি পর্যটন শিল্পের। আমরা সম্মিলিতভাবে যদি প্রচেষ্টা চালাই তাহলে অচিরেই পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিবে। আসুন আমরা সকলে মিলে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে অনিবার ভালােবাসায় ভরিয়ে তুলি। আর জগদ্বাসীকে আপন করে গ্রহণ করি নিজের দেশে পরম আতিথেয়তায়।

আরো দেখুন (বাংলা প্রবন্ধ রচনা) :

Paragraph : Padma Bridge

Padma Bridge

One of the dream projects of Bangladesh is Padma Bridge. It will be the world’s sixth-largest multipurpose bridge. In December 2014 the bridge started its construction journey and opened for common use on 25 June 2022. Although, it wasn’t easy at the start considering funds and other economic issues. Even, the World Bank cancelled its credit agreement. At last, the country had come up with its own found. But the country, economic issue was not the only thing to deal with. Because river Padma has two natures – calm in winter and cruel in summer. So, Engineers divided the construction process into five parts to solve this problem. The first of them was constructing the main bridge. That’s 6.15km in length. This phase includes setting up 41 spans. River training is the second part. Probably the most difficult part of the process. The 3rd and 4th parts are connecting links which are to connect the bridge with two highways. One will be made in Janjira and another in Mawa. Service area construction for servicing is the 5th step. The last of them is supervision of the whole project. Padma bridge will connect the south-west region of the country with the capital and eastern part. For this, regional cooperation will increase and transport management will be convenient. In addition, it will play an important role in the economic sector of Bangladesh. Industrial development and employment opportunities will cause radical changes in the condition of south-west residents. Not only economy and transportation facilities will increase but also medical and educational facilities will be easy to access. The world will witness the history of proud Bangladesh.


Essay : Padma Bridge : Economic and Social Mutation

Padma Bridge : Economic and Social Mutation

The construction of Padma Bridge is expected to be inaugurated by June 2022. It is the longest bridge in Bangladesh. The infrastructure has come up with abundant possibilities, especially for the marginalized people living in the southwestern part of Bangladesh.

Padma Bridge will add substantially to the Gross Domestic Product (GDP) of Bangladesh through the creation of strong supply chains that will increase investment, external and internal trade, employment and socioeconomic status of the people in that region. It is expected that the bridge will contribute to nearly twp percent of GDP in our economy. Ease of transportation will create new business opportunities for the agricultural and industrial sectors. This will generate a new investment hub for both local and foreign investors which will lead to the industrial development with a huge employment opportunity. As demand for labour increases, there will be more recruitment, reskilling or up-skilling wages. The wider economic opportunities will eventually alleviate poverty, raise living standards and produce intergenerational gains through greater affordability of education and healthcare.

 

Economic Mutation

Establishing new routes

the Padma isolates the southern part from the rest of the country. Despite significant road-transport development in the southern region, a bridge was of the essence to pull off the efficiency of such improvements. Struggle in ferry worsen every year with an increasing number of vehicles. The waiting time at ferry points is more than two hours for buses and light vehicles and almost 10 hours for trucks. The struggles allude to an abysmal local condition when it comes to travelling. However, there has not been much projection of the annual economic and man-hour loss caused by the delay at ferry ghats, a TV channel corroborated that in August 2020, toll collection of 80 million BDT was recorded against a toll collection of 240 million BDT in the same month of the previous year 2019.

There is also an absence of direct roadways through the Tamabil-Sylhet-Sorail-Kanchpur-Dhaka-Mawa-Bhatiapara-Norail-Jessore-Benapole highway which will be resolved by the bridge said the appraisal report of WB. the bridge will create connectivity of roads, railways, and energy transportation easing international connectivity to India, Bhutan, and Nepal by linking to the Trans-Asian highway (N-8) and Trans-Asian railway. The burgeoning network and connectivity have thus far led to creating economic zones, high-tech parks, private industrial cities, and so on.
Reducing struggle of riverine sites: the southwest region covers 27% of the nation’s population. But the region has been relatively under the radar when it comes to economic development compared to other parts. Climate change has caused problems like losing lands, erosion, business leading to migration. The outskirts of Padma also have prevailing poverty due to climate and network issues. As a result, the proportion of the population living below the poverty line in the southwest region is 5% higher than the rest of the country. The Padma bridge will remedy these issues.

 

Industrial revolution in 21 districts

the imminent establishment of the Padma bridge is supposed to deliver an Economic Rate of Return (ERR) of investing in the bridge of 18-22% per year which is subject to increase. Formerly insular lands have now been accredited as lands of high value because of some form factors.

Transportation will be conducive to the local businesses as the connection from Dhaka to port cities has lessened. For agribusiness, delivery will be a lot faster cutting costs on storage guaranteeing product quality. Real estate businesses will rebound from previous losses as nearby areas are expected to be vastly industrialized by factories, mega factories, hospitals, universities and housing facilities. Hotel businesses in Barisal, shipwrecking industries in the two seaports, liquified natural gas stations (LNG) industries are planned to be set up far above and beyond after the opening of the bridge. According to BSCIC officials, around 500-1000 factories of various categories are projected to be established in areas surrounding Barisal. The district is expected to contribute 2% growth to the national economy due to industrialization caused by the bridge.

 

Increasing GDP

The post establishment period of the Padma bridge is supposed to bolster our economy in many ways. The long-term road user’s benefit was calculated using the traffic model. This was based on the savings or vehicle operation cost and savings in travel time cost. The estimation stood at 1,295,840 million BDT ($18,512 million) over the 31 years.

Two simulations resulted in a 100% and a 70% investment stimulus felt in the southwest region over a direct injection of $2.1 billion into the regional economy. This would add a value of about 453,670 million BDT over a 31-year period which draws a 10.6% growth. Annually this rate would be 0.33% of the national base GDP.

 

Increasing international trade

From a foreign trade standpoint, Bangladesh has already started receiving investments for setting up businesses near the construction. Manufacturing businesses, RMG, assembling plants, storage facilities are most likely to be focused on. New workplaces will add to new employment serving the government’s purpose. Creating strong ties to the two main seaports, exports are projected to grow and so will more export-import zones. The government will gain a substantial amount of taxation and toll post-project completion adding to its revenue.

Social Mutation

The Padma Bridge is estimated to increase the GDP of the country by more than one percent. It will benefit about three crore people across 21 south-western districts of Bangladesh. These districts will be connected with the growth centres through better connectivity. They can be used as economic corridors. This will create opportunities for employment and income. The transportation system will be enhanced. Supply chains within the country will be connected better. Goods and services will move smoothly from one place to another. People from the south-western parts of the country are also expected to have better access to education, healthcare and other services.

 

Conclusion

Not only will people move to the urban areas easily, opportunities will also come to the rural areas. This will change the rural economy which is already undergoing transformation. The share of the agriculture sector to the GDP of the country has declined significantly with the emergence of non-farm activities in the rural areas. This was facilitated by several factors including better communication and connectivity.

Therefore, once the bridge is fully functional, monitoring and evaluation of the infrastructure will be critical to get the expected return. The construction of the bridge has been a landmark achievement of the government. But without its efficient management and governance, the rate of return from this mega project will be low. Finally, as Bangladesh is working towards reviving the economy from the fallouts of the Covid-19 pandemic, the Padma Bridge can help the country fulfil this effort to a great extent. It can also contribute towards achieving sustainable development.
Facts File:

  • Project Name : Padma Multipurpose Bridge Project
  • Directly Connected Districts : 3, Munshigang, Madaripur and Shariatpur
  • Connected Point : Mawa, Lauhajong, Munshiganj to Zajira, Shariatpur
  • Construction Start : 12 December 2015
  • Construction Cost : BDT 301933.88 Million or, USD 3.868 Billion (Including VAT and IT)
  • Construction Company : China Railway Major Bridge Engineering Company Limited
  • Length : 6.15 km (20,177.17 ft)
  • Width : 18.10m (59.38 ft)
  • Viaduct : 3.148 km (Road), 532m (Rail)
  • Longevity : 100 years
  • Earthquake Resistance : 9 Richter scale
  • Spans : 41
  • Pillars/Piers : 42
  • Piles : 294
  • Design : AECOM (United States)
  • Feasibility Study : Finalized by JICA
  • First Span set-up : 30 September 2017
  • 41th Span set-up : 10 December 2020

সাধারণ জ্ঞান : পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে জুনেই। উদ্বোধনের তারিখ ২৫ জুন ২০২২। পদ্মা সেতু সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ-

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাম — পদ্মা বহুমুখী সেতু

পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ — ৬.১৫ কিলোমিটার

পদ্মা সেতুর প্রস্থ — ২২ মিটার

পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা — ৬০ ফুট (প্রায় ১৮ মিটার)

পদ্মা সেতুর মোট পিলারের সংখ্যা — ৪২টি

পদ্মা সেতুর পিলারের নিচে স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে — ১২২ মিটার গভীরে

পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম — সর্বোচ্চ ১২২ মিটার

পদ্মা সেতুর পাইল-সংক্রান্ত সমস্যায় গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করে ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান — COWI

প্রতিটি পিলারের জন্য পাইলিং করা হয়েছে — ছয়টি (মাটি নরম হওয়ায় ২২টি পিলারের পেইলসংখ্যা সাতটি করে)

পদ্মা সেতুর পিলারের পাইল বসানোর জন্য হাইড্রোলিক হাতুড়ি (হ্যামার) নিয়ে আসা হয়েছিল যে দেশ থেকে — জার্মানি (সবচেয়ে বড় হ্যামারটির ক্ষমতা তিন হাজার কিলোজুল)

পদ্মা সেতুতে ১৫০ মিটার দৈর্ঘের স্প্যান বসানো হয়েছে — ৪১টি

পদ্মা সেতুর স্প্যান তৈরি হয়েছে চীনের হুবেই প্রদেশের — শিংহুয়াংডাও শহরে

পদ্মা সেতুতে স্প্যান বসানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেন — তিয়ান-ই (ক্রেনটির ধারণক্ষমতা ৩ হাজার ৬০০ টন আর স্প্যানের ওজন ৩ হাজার ২০০ টন)

পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের (মাওয়া-জাজিরা) সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ — ১৪ কিলোমিটার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতু নির্মাণ ও নদীশাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন — ১২ ডিসেম্বর ২০১৫

পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসনের কাজ শুরু হয় — ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে

পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসনের কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি হয় — ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকার (১১০ কোটি মার্কিন ডলার)

পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে নদীশাসন করা হয়েছে — ১২ কিলোমিটার

বিশ্বের প্রথম সেতু হিসেবে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে — কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে

পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে রয়েছে — মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা

পদ্মা সেতুর নকশা তৈরি করেছে আমেরিকান কোম্পানি — Maunsell Ltd. AECOM NZL Architecture, Engineering, Consulting, Operations and Maintenance (AECOM)

পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান — এম শামীম জেড বসুনিয়া

পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক দলে কাজ করছেন কমবেশি — ১৪টি দেশের প্রকৌশলীরা

পদ্মা সেতু প্রকল্পে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি রয়েছে — ১১ সদস্যের (কয়েক মাস পরপর বৈঠক করে কমিটি প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি বিষয়ে পরামর্শ দেন)

পদ্মা সেতুতে রেলপথ সংযোগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় — ১১ জানুয়ারি ২০১১

পদ্মা সেতুতে রেললাইন থাকবে — একটি (এর ওপর দিয়ে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ-দুই ধরনের ট্রেন চলাচলেরই ব্যবস্থা থাকবে)

পদ্মা সেতুসংশ্লিষ্ট ঢাকা থেকে যশোর রেল প্রকল্পের অর্থায়ন করছে — চীন (জি টু জি ভিত্তিতে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড)

পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প রকনেকে পাস হয় — ৩ মে ২০১৬

পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা অর্থসহায়তা দিচ্ছে — চীনের এক্সিম ব্যাংক

পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প তত্ত্বাবধান করছে — বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বুয়েট

পদ্মা সেতুসংশ্লিষ্ট ঢাকা থেকে যশোর রেল প্রকল্পের দৈর্ঘ — ১৭২ কিলোমিটার (রেল প্রকল্পের উদ্বোধন-১৪ অক্টোবর ২০১৮)

পদ্মা সেতুতে রেললাইন বসানোর জন্য বিশেষ ধরনের কংক্রিট স্ল্যাব বসাতে হবে — ২ হাজার ৯৫৯টি

পদ্মা সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান বসানো হয় — ৩০সেপ্টেম্বর ২০১৭

পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর সর্বশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসানো হয় — ১০ডিসেম্বর ২০২০

সর্বশেষ স্প্যানটি স্থাপনের আগে এটির এক পাশে টাঙ্গানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, অন্য পাশে — চীনের পতাকা

পদ্মা সেতু তৈরির প্রথম প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় — ১৯৯৯ সালে

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন — ৪ জুলাই ২০০১

পদ্মা সেতু নির্মাণ করে লাভ কী হবে, তা নিয়ে ২০০৯ সালে আলাদা সমীক্ষা করে — এডিবি ও জাপানের সহযোগিতা সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)

২০০৯ সালে এডিবি ও জাপানের সহযোগিতা সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সমীক্ষায় দেখা যায়, পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন (ইআরআর) দাঁড়াবে বছরে — ১৮-২২ শতাংশ

‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’ প্রকল্পের পরিচালক — মো. শফিকুল ইসলাম

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয় — ২৮ এপ্রিল ২০১১

বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ চুক্তি বাতিল করে — ৩০ জুন ২০১২

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় — ৯ জুলাই ২০১২

বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংককে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের অনুরোধ ফিরিয়ে নেয় — ৩১ জানুয়ারি ২০১৩

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা হয় — জুন ২০১৩ সালে

পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি হয় — ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকার

পদ্মা সেতু প্রকল্পে তদারক করছে — বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি)

পদ্মায় মূল সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক — দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের

পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে দক্ষিণাঞ্চলের — ২১টি জেলার

পদ্মা সেতু চালু হলে সারা দেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের — ২৯ জেলার সঙ্গে

পদ্মা সেতুর অবস্থান হচ্ছে — ৩টি জেলায় (মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর)

পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযোগ হবে — দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাংশের

পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট অংশ — ৩.১৮ কিলোমিটার (মূল সেতুর স্থলভাগের অংশকে ভায়াডাক্ট বলে, যেখানে এসে বাস ও ট্রেনের পথ আলাদা হয়ে মাটিতে মিশবে)

ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটারের এক্সপ্রেসওয়েটির কাজ শুরু হয় — ২০১৬ সালে

ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটারের এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেওয়া হয় গত — ১২ মার্চ ২০২০

ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হয়েছে — প্রায় ১১ হাজার ৪ কোটি টাকা

বিশ্বের সড়ক সেতুর তালিকায় পদ্মা সেতুর অবস্থান — ২৫তম (এশিয়ায় দ্বিতীয়। বিশে প্রথম হুং জুং বে সেতু, চীন-৩৫ কিলোমিটার)

পদ্মা সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের’ সক্ষমতা হচ্ছে — ১০ হাজার টন (এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি)

পদ্মা সেতুর ভূমিকম্পসহনীয় মাত্রা রিখটার স্কেলে — ৯ মাত্রা পর্যন্ত

পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সরকার সেতু বিভাগিকে ১% সুদে ঋণ দিয়েছে- ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা (৩৫ বছরের মধ্যে পরিশোধ করবে সেতু বিভাগ)

পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে — ১দশমিক ২৩ শতাংশ হারে

পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে — ২ দশমিক ৩ শতাংশ

পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশে দারিদ্র বিমোচনের হার বাড়বে — ০.৮৪ শতাংশ

পদ্মা সেতুর ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব বসাতে হবে — ২ হাজার ৯১৭টি

পদ্মা সেতু দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন যাবে — ৭৬০ মিলিমিটার ব্যাসার্ধের

পদ্মা সেতু দিয়ে ফাইবার অপটিক ও টেলিফোন কেবলের লাইন বসানো হবে — ১৫০ মিলিমিটার ব্যাসার্ধের

প্রকল্পের কাজে ব্যবহিত স্টিলের সব কাঠামো — চীন থেকে এসেছে

পদ্মা সেতুর রেলের গার্ডার (স্ট্রিনজার) এসেছে — লুক্সেমবার্গ থেকে

পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোর রং হবে — ধূসর

পদ্মা সেতু দেখতে অনেকটা ইংরেজি বর্ণ — এস-এর মতো

সর্বশেষ প্রাক্কালিত ব্যয় — ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা


স্বপ্নের পদ্মা সেতু

স্বপ্নের পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতুতে মোট ৪১৫ টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুতে ৩২৮টি, জাজিরা প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৪৬টি ও মাওয়া প্রান্তের ভায়াডাক্টে ৪১টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। গত ১৮ এপ্রিল এসব ল্যাম্পপোস্ট ও এর মধ্যে বাতি লাগানোর কাজ শেষ হয়। এরপর পুরো সেতুতে বৈদ্যুতিক তার টানা হয়েছে। গত বছর ২৫ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে প্রথম ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শুরু হয়েছিলো। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার কোটি টাকায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর কাজের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্মাণকাজ শেষে ২৫ জুন ২০২২ এই স্বপ্নের সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে।

 

পদ্মা সেতু সম্পর্কিত তথ্য

স্থানাঙ্ক : ২৩.৪৪৬০° উত্তর ৯০.২৬২৩° পূর্ব
বহন করে : যানবাহন, ট্রেন
অতিক্রম করে : পদ্মা নদী
স্থান : মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর
অফিসিয়াল নাম : পদ্মা বহুমুখী সেতু
রক্ষণাবেক্ষক : বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ
ওয়েবসাইট : www.padmabridge.gov.bd

পদ্মা সেতুর বৈশিষ্ট্য
নকশা : এ.ই.সি.ও.এম
উপাদান : কংক্রিট, স্টিল
মোট দৈর্ঘ : ৬.১৫ কিলোমিটার (২০,২০০ ফুট)
প্রস্থ : ১৮.১০ মিটার (৫৯.৪ ফুট)

পদ্মা সেতুর ইতিহাস
নকশাকার : AECOM
নির্মাণকারী : চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লি.
নির্মাণ শুরু : নভেম্বর ২০১৪ ইং
নির্মাণ শেষ : জুন ২০২২ (আনিমানিক)
চালু : ২৫ জুন ২০২২

 

পদ্মা সেতুর অবস্থান

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। চলতি বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে এর ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘের ৪১টি স্প্যান ইতিমধ্যে বসানো সম্পন্ন হয়েছে, ৬.১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় সেতু। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি জানিয়েছে, পদ্মা সেতু যান চলাচলের উপযোগী হতে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত লেগে যাবে। ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন চূড়ান্ত করা হয়েছে।

 

নির্মাণের ইতিহাস

২০০৬-০৭ সালে প্রকল্প প্রস্তুতির সাথে যুক্ত কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় বিশ্বব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্যান্য দাতারা সেটি অনুসরণ করে। এই ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় ও সচিব মোশারেফ হোসেন ভূইয়াকে জেলেও যেতে হয়েছিল। পরবর্তীতে এমন কোনও অবিযোগ প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়। দুর্নীতির অভিযোগ পরবর্তীতে আদালতে খন্ডিত হয়। বর্তমানে প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়ন করা হচ্ছে।

AECOM-এর নকশায় পদ্মা নদীর উপর বহুমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট। সে সময় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়িয়েছে সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) ২০১০ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের জন্য প্রাক যোগ্যতা দরপত্র আহবান করে। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে, ২০১১ সালের শুরুর দিকে সেতুর নির্মাণ কাজ আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল এবং ২০১৩ সালের মধ্যে প্রধান কাজগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটি তিনটি জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করবে- মুন্সিগঞ্জ (মাওয়া পয়েন্ট/উত্তর পাড়), শরীয়তপুর এবং মাদারীপুর (জাঞ্জিরা/দক্ষিণ পাড়)। এটির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অধিগ্রহণকৃত মোট জমির পরিমাণ ৯১৮ হেক্টর।

 

পদ্মা সেতুর নকশা

পদ্মা বহুমুখী সেতুর সম্পূর্ন নকশা এইসিওএমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল তৈরি করে। বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ সেতু প্রকল্প যমুনা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা হয়। আধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরিকে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এ প্যানেল সেতুর নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে কর্মকর্তা, নকশা পরামর্শক ও উন্নয়ন সহযোগীদের বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করে।

 

কর্মপরিকল্পনা

পদ্মা সেতুর ভৌত কাজকে মূলত পাঁচটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে যথা- (ক) মূল সেতু, (খ) নদী শাসন, (গ) জাজিরা সংযোগকারী সড়ক, (ঘ) টোল প্লাজা ইত্যাদি। মাওয়া সংযোগকারী সড়ক, টোল প্লাজা ইত্যাদি এবং মাওয়া ও জাজিরা সার্ভিস এলাকা। প্রকল্পে নিয়োজিত নকশা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মনসেল-এইকম’ ভৌত কাজের ঠিকাদার নিয়োগের প্রাক-যোগ্যতা দরের নথি প্রস্তুত, টেন্ডার আহবানের পর টেন্ডার নথি মূল্যায়ন, টেন্ডার কমিটিকে সহায়তাসহ এ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল নকশা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ তদারক করত। ভৌত কাজের বিভিন্ন প্যাকেজের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি।

 

পাইলিংয়ের সমস্যা

প্রথম দিকে পদ্মা নদীর তলদেশের মাটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় সেতু নির্মাণকারী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের। তলদেশে স্বাভাবিক মাটি পাওয়া যায়নি। সেতুর পাইলিং কাজ শুরুর পরে সমস্যা দেখা যায়। প্রকৌশলীরা নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটির বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথার চেষ্টা করে। স্ক্রিন গ্রাউটিং নামের এই পদ্ধতিতেই বসানো হয় পদ্মাসেতু। এরকম পদ্ধতির ব্যবহারের নমুনা বিশ্বে তেমন একটা নেই। এ প্রক্রিয়ায় ওপর থেকে পাইপের ছিদ্র দিয়ে কেমিক্যাল নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটির শক্তিমত্তা বাড়ানো হয়েছে। তারপর ওই মাটিতে গেঁথে দেওয়া হয়েছে পিলার। এমন পদ্ধতির প্রয়োগ বাংলাদেশে এই প্রথম। এ পদ্ধতিতে পাইলের সঙ্গে স্টিলের ছোট ছোট পাইপ ওয়েন্ডিং করে দেওয়া হয়। পাইপের ভেতর দিয়ে এক ধরনের কেমিক্যাল পাঠিয়ে দেওয়া হয় নদীর তলদেশের মাটিতে। কেমিক্যালের প্রভাবে তখন তলদেশের সেই মাটি শক্ত রূপ ধারণ করে। একপর্যায়ে সেই মাটি পাইলের লোড বহনে সক্ষম হয়ে ওঠে। তখন আর পাইল বসাতে কোনো বাধা থাকে না।

 

নির্মাণ ব্যয়

পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।

 

ক্রমিক ব্যয় বৃদ্ধি

২০০৫-এ পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক প্রাক্কালন করা হয়েছিল ১২,০০০/- কোটি টাকা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় পৃথিবীর অন্যান্য তুলনীয় সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের নিরিখে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী সর্বোমোট নির্মাণ ব্যয় ১০,০০০/- কোটি টাকায় সীমিত রাখার পরামর্শ প্রদান করেন।

২০০৭ এর আগস্ট মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একনেক-এর সভায় পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত প্রাক্কালন ১০,১৬১/- কোটি অনুমোদন করা হয়।

পরবর্তী কালে বিভিন্ন সময়ে প্রাক্কলন বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ অনুমোদিত প্রাক্কলনের পরিমাণ ৩০,১৯৩/- কোটি টাকা যা মূল প্রাক্কলনের চেয়ে ২০,০৩২/- কোটি টাকা বেশী। বলা হয়েছে বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়াই প্রকল্প ব্যয় এতো বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ।

মার্কিন ডলারের হিসাবে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সড়ক-রেল সেতুর নির্মাণ ব্যয় এগারো বছরে ১.৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩.৫৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। চীনের ৬.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উফেনসাং ইয়াংজী সড়ক-রেল সেতু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চালু করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে তুলনীয় এই সেতুর নির্মাণে ৪ বছর লেগেছে এবং ব্যয় হয়েছে ১.০৫ বিলিয়ন ডলার যা পদ্মা সেতুর এক-তৃতীয়াংশের চেয়েও কম।

 

নির্মাণের সময়ক্রম

২০১৭

  • ৩০ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পদ্মা সেতুতে পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে এই স্প্যান বসানো হয়।
  • ১১ মার্চ ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলারের ওপর বসে তৃতীয় স্প্যান
  • ১৩ মে ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারের ওপর চতুর্থ স্প্যান বসানো হয়।
  • ২৯ জুন সেতুর পঞ্চম স্প্যান বসানো হয়েছে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকায়।

 

২০১৮

  • জানুয়ারি মাসে জাজিরা প্রান্তের তীরের দিকের ষষ্ঠ শেষ স্প্যান বসে
  • ২৮ জানুয়ারি পদ্মা সেতুর ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিলারের ওপর দ্বিতীয় স্প্যান ৭বি সুপার স্ট্রাকচার বসানো হয়। প্রথম স্প্যান বসানোর প্রায় চার মাস পর জাজিরা নাওডোবা প্রান্তে তিন হাজার ১৫০ টন ধারণ ক্ষমতার এ স্প্যান বসানো হয়
  • মাওয়া প্রান্তে ৪ ও ৫ নম্বর পিলারের ওপর বসে সপ্তম স্প্যান

 

২০১৯

  • ২০ ফেব্রুয়ারি জাজিরা প্রান্তে ৩৬ ও ৩৫ নম্বর পিলারের ওপর অষ্টম স্প্যান বসানো হয়
  • ২২ মার্চ সেতুর ৩৫ ও ৩৪ নম্বর পিলারের ওপর বসে নবম স্প্যানটি
  • ১০ এপ্রিল মাওয়া প্রান্তে ১৩ ও ১৪ নম্বর পিলারের ওপর দশম স্প্যান
  • ২৩ এপ্রিল শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৩ ও ৩৪ নম্বর পিলারের ওপর ১১তম স্প্যান বসে
  • ১৭ মে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝামাঝি স্থানে ২০ ও ২১ নম্বর পিলারের ওপর ১২তম স্প্যান বসানো হয়েছিল
  • ২৫ মে ১৪ ও ১৫ নম্বর পিলারের ওপর ১৩তম স্প্যান ৩বি বসানো হয়
  • ২৯ জুন ১৪ তম স্প্যান বসানো হয়
  • ২২ অক্টোবর জাজিরা প্রান্তে ২৪ ও ২৫ নম্বর পিলারের ওপর পদ্মা সেতুর ১৫তম স্প্যান বসানো হয়েছিল
  • ২৭ নভেম্বর মাওয়া প্রান্তে ১৬ ও ১৭ নম্বর পিলারের ওপর ১৬তম স্প্যানটি বসানো হয়
  • ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পিলার ২২ ও ২৩-এর ওপর মূল সেতুর ১৭তম স্প্যানটি বসানো হয়
  • ১১ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ১৮তম স্প্যান বসানো হয়
  • ১৮ ডিসেম্বর বসানো হয় ১৯তম স্প্যান
  • ৩১ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে ১৮ ও ১৯ নম্বর পিলারের উপরে বসানো হয় পদ্মা সেতুর ২০তম স্প্যান। ধূসর রঙের ‘৩-এফ’ নবরের স্প্যানটি খুঁটির উপরে বসানো হয়

 

২০২০

  • ১৪ জানুয়ারি পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে ৩২ ও ৩৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় ২১তম স্প্যান
  • ২৩ জানুয়ারি মাওয়া প্রান্তের ৫ ও ৬ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় ২২তম স্প্যান
  • ২ ফেব্রুয়ারি বসেছে ২৩তম স্প্যান
  • ১১ ফেব্রুয়ারি বসেছে ২৪তম স্প্যান
  • ২১ ফেব্রুয়ারি ২৫তম স্প্যান বসানো হয়
  • ১০ মার্চ পদ্মা সেতুর ২৬তম স্প্যান বসানো হয়। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ২৮ ও ২৯ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় এই স্প্যান
  • ২০ এপ্রিল ২৭তম স্প্যানটি পিলার-২৭ ও ২৮ এর ওপর বসানো হয়
  • ১১ এপ্রিল জাজিরা প্রান্তে বসানো হয় ২৮তম স্প্যান
  • ৪ মে মাওয়া প্রান্তে সেতুর ১৯ ও ২০তম পিলারের ওপর ‘৪এ’ আইডি নম্বরে সেতুর ২৯তম স্প্যান বসানো হয়
  • ৩০ মে জাজিরা প্রান্তে সেতুর ২৬ ও ২৭ নম্বর পিলারের (খুঁটি) ওপর বসানো হয় ৩০তম স্প্যান
  • ১০ জুন পদ্মা সেতুর ৩১তম স্প্যান বসানো হয়। সেতুর ২৫ ও ২৬ নম্বর পিলারে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৫-এ স্প্যান বসানো হয়
  • ১১ অক্টোবর পদ্মা সেতুর ৩২ নম্বর স্প্যানটি বসানো হয়। পদ্মায় তীব্র স্রোতের কারণে প্রথম দিন বসানো সম্ভব না হলেও প্রকৌশলীদের প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় দিনে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর ৪ ও ৫ নম্বর পিলারের ওপর স্প্যানটি বসানো হয়। বন্যা ও পদ্মা নদীর তীব্র স্রোতের কারণে স্প্যানটি বসানো হয় চার মাস পর।
  • ২০ অক্টোবর বসানো হয় সেতুর ৩৩তম স্প্যান
  • ২৫ অক্টোবর ৩৪তম স্প্যান বসানো হয় সেতুর মাওয়া প্রান্তে ৭ ও ৮ নম্বর পিলারের ওপর স্প্যান ২-এ
  • ৩১ অক্টোবর ৩৫তম স্প্যান বসানো হয় মাওয়া প্রান্তে ৮ ও ৯ নম্বর পিলারের ওপর স্প্যান ২-বিতে
  • ৬ নম্বর পদ্মা সেতুর ৩৬তম স্প্যান বসানো হয় সেতুর মাওয়া প্রান্তের ২ ও ৩ নম্বর পিলারের ওপর
  • ১৩ নভেম্বর ৩৭তম স্প্যান ‘২-সি’ মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে ৯ ও ১০নং পিলারের ওপর বসানো হয়
  • ২১ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের ১ ও ২ নম্বর খুঁটির ওপর ৩৮তম স্প্যানটি সফলভাবে বসানো হয়
  • ২৭ নভেম্বর ৩৯তম স্প্যান বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়। স্প্যানটি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের ১০ ও ১১ নম্বর পিলারের ওপর ‘টু-ডি’ স্প্যানটি বসানো হয়।
  • ৪ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ৪০তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় সেতুর ছয় হাজার মিটার
  • ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩তম পিলারের ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু

 

২০২১

  • ২৩ আগস্ট সর্বশেষ সড়ক স্লাব বসানো হয়

 

চুক্তিবদ্ধ সংস্থা

২০১৪ সালের ১৭ জুন পদ্মা সেতু নির্মানে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয় বাংলাদেশ সরকার ও চীনা চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চীনের কোম্পানি পদ্মাসেতুর কার্যাদেশ পায়। পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০১০ সালে প্রথম দরপত্র আহবান করা হলে সেখানে প্রি কোয়ালিফিকেশনের জন্য ৪০টি কোম্পানি অংশ নেয়। বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবির তত্ত্বাবধানে এদের মধ্যে ৫টি কোম্পানিকে বাছাই করা হয়। পরে বিশ্বব্যাংকের আপত্তির কারনে একটি কোম্পানি বাদ পড়ে যায়। আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয়। সেতুটি তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড এর আওতাধীন চায়না মেজর ব্রীজ নামক একটি কোম্পানী। কাজ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর ২০১৪। এতে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

 

প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা

পদ্মা বহুমুখী সেতুঃ ২০২১ সালের জিন পর্যন্ত, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বি-স্তরের পদ্মা বহুমুখী সেতুর ৯৩.৫% (সমস্ত মূল ইস্পাত ফ্রেম স্প্যানস সেট করা আছে) নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর জন্য নিযুক্ত চীন মেজর ব্রীজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (এমবিইসি) কাজটি সম্পাদন করছে। নদী প্রশিক্ষণের জন্য গত চার মাস ধরে মাটি পরীক্ষা ও ড্রেজিংয়ের কাজ চলছে। ব্রিজটিতে মোট ৪২টি পিলার থাকবে। প্রত্যেকের নীচে ছয়টি পাইল থাকবে। স্তম্ভগুলিতে ইস্পাত স্প্যান স্থাপন করা হবে। ব্রিজটির মোট ৪১টি স্প্যান থাকবে। পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজটি মূলত পাঁচটি ভাগে বিভক্ত- মূল সেতু, নদীর প্রশিক্ষণ, দুটি সংযোগ সড়ক এবং অবকাঠামো (পরিষেবা অঞ্চল) নির্মাণ। চীনের সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন নদীর প্রশিক্ষণ কাজের জন্য নিয়োগ পেয়েছিল এবং বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অক্টোবর ২০১৭ সালে, মূল নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার দেড় বছরেরও বেশি সময় পরে ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর, ৪২টির মধ্যে ৪২টি পিলারের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই সেতুর চূড়ান্ত (৪১তম) স্প্যানটি বসানো হয় ১০ই ডিসেম্বর ২০২০। সমাপ্তির পরে এই সেতুটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু হবে। ব্রিজটির নতুন সমাপ্তির তারিখ ২০২২ সালের জুনে অনুমান করা হচ্ছে।

 

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

প্রস্তাবিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের ১৯ জেলার সাথে সরাসরি সংযোগ তৈরি করবে। এই সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪,০০০ বর্গ কিঃমিঃ (১৭,০০০ বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। ফলে প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপুর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটিতে ভবিষ্যতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিক কেবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। এই সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।

বিতর্ক ও গুজবঃ জুলাই ২০১৯ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা লাগবে বলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে গুজব ছড়ায়। এতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অপহরণকারী ধারণা করে অনেক মানসিক ভারসাম্যহীনকে মারধর করে পুলিশে হস্তান্তর করার ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনাকে গুজব ও ভিত্তিহীন উল্লেখ করে ৯ জুলাই ২০১৯ তারিখ সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। এক্ষেত্রে গবেষকরা সেতু কর্তৃপক্ষকে সেতুটি নির্মাণে খুঁটিনাটি সকল তথ্য জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন।

  • পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি)কে ১.২ শতাংশ বাড়িয়ে দিতে পারবে বলে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের ধারণা
  • তবে শুধু তা-ই নয়, পদ্মা সেতুর নকশায় বেশ কিছু বিরল বিশেষত্ব রয়েছে। যা গোটা দুনিয়ার কাছেও বাংলাদেশকে শ্রেষ্ঠত্বের খ্যাতি এনে দিয়েছে।
  • এটি আসলে দোতলা সেতু। এর একতলায় অর্থাৎ নদীর কাছাকাছি চলবে ট্রেন। সামান্য উপরে চার লেনের চওড়া রাস্তায় চলবে সব রকম গাড়ি
  • নদীর কাছাকাছি হলেও রেল ব্রিজ থেকে জলের দূরুত্ব থাকবে অন্তত ১৮ মিটারের। ফলে জলস্তর বাড়লেও রি ব্রিজের তলা দিয়ে পাঁচতলা সমান জাহাজের যাতায়াতে অসুবিধা হবে না।
  • পদ্মা সেতুকে জলের মধ্যে ধরে রাখবে ৪০টি পিলার বা স্তম্ভ। প্রত্যেকটিই তৈরি হয়েছে মজবুত পাইল ইস্পাত দিয়ে। তবে এর পাশাপাশি এই পিলারের আর একটি বিশেষত্ব রয়েছে। জলের নীচে ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে গিয়েছে এই পিলারের ভিত। পৃথিবীর আর কোনও দেশে আর কোনও সেতুর স্তম্ভ এত গভীরে নেই
  • নিরাপত্তার আর একটি ব্যবস্থা পদ্মা সেতুর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। পদ্মা সেতুর ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ পৃথিবীর অন্য সব সেতুর চেয়ে অনেক বেশি। প্রায় ১০ হাজার টন। এই ক্ষমতায় এই সেতু রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও অনায়াসে টিকে যাবে।
  • পদ্মা সেতুতে সাধারণ আলোর ব্যবস্থা ছাড়াও থাকছে ‘আর্কিটেকচারাল লাইটিং’। সেতুর সৌন্দর্যায়নের জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি সংগ্রহশালাও। তাতে পদ্মা সেতু তৈরির বিভিন্ন উপকরণ প্রদর্শন করা হবে।

রচনা : বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ [16 পয়েন্ট]

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ

ভূমিকা

বাংলাদেশ একটি প্রাচীন দেশ। প্রাচীনত্বের গরিমায় বাংলা সারা বিশ্বে পরিচিত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজা বাদশাহর পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দারুণভাবে উন্নতি লাভ করেছে। দেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ইতিহাস বিদেশে পর্যটকদের আকর্ষণ করে দেশের জন্য আর্থিক সমৃদ্ধি আনয়ন করেছে। বর্তমানে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা বর্তমান।

 

বাংলাদেশের পর্যটন স্থান

নীচে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থানগুলোর বিবরণ দেওয়া হলো-

১। কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত : বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতের অবস্থান বাংলাদেশের কক্সবাজারে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ কিলোমিটার। আরও রয়েছে দক্ষিণ অঞ্চলের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। যেখান থেকে দেখা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য।

২। সেন্টমার্টিন : আমাদের আছে জগদ্বিখ্যাত প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি প্রবালদ্বীপের নামই সেন্টমার্টিন। নারকেল গাছে ঘেরা যার সৈকত। এর আরেক নাম নারিকেল জিঞ্জিরা।

৩। রাঙামাটি ও বান্দরবান : পাহাড়-পর্বত ঘেরা বান্দরবান, রাঙামাটির সবুজ বনানীতে অপরূপ সৌন্দর্য সহসাই মনকে আকৃষ্ট করে। ছোটবড় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদী, ঝরনা আন হ্রদের অপার নান্দনিকতা যেকোনো মানুষকে বার বার হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাহাড়ি উপজাতিদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার বর্ণাঢ্য রূপ মুগ্ধ করে পর্যটন প্রিয়দের।

৪। সুন্দরবন : বাংলাদেশেই অবস্থিত পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন যার নাম সুন্দরবন। খাল, নদী, সাগর দ্বারা বেষ্টিত সুন্দরবনের জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। সে বাঘ ভুবন বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে অভিহিত। সুন্দরবনে অবস্থানকালে পর্যটকদের ঘুম ভাঙবে অগণিত পাখির কলকলানিতে যা একজন পর্যটককে স্বপ্নিল আবেশে মুগ্ধ করতে পারে।

৫। চা বাগান ও জলপ্রপাত : সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোও বেশ সৌন্দর্যমন্ডিত। যা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। জাফলংয়ের জলপ্রপাত, ছাতকের পাথর কেয়ারী নয়নভোলানো স্থান। এছাড়া তামাবিল, চট্টগ্রামে ফয়েজ লেক, বঙ্গবন্ধু সেতু ইত্যাদি পর্যটনের স্থান হিসেবে বেশ সমাদৃত।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প নানাভাবে অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশের এমনিতেই রপ্তানি কম। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কোনো খাতই তেমন শক্তিশালী নয়। এই প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে পর্যটনের মতো ‘অদৃশ্য রপ্তানি পণ্য’ খাতে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারে। পর্যটন শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিরাজমান সমস্যাগুলো হলো-

১। অবকাঠামোগত দুর্বলতা : এই খাতের অবকাঠামো মারাত্মকভাবে দুর্বল। পরিবহণ ব্যবস্থা মান্ধাতার আমলের। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সত্ত্বেও এখনও রয়েছে অনেক দুর্বলতা। রাস্তাঘাট সংকীর্ণ, অনেক জায়গায় বিপজ্জনক। প্রায়শই যানজটে অযথা সময় ও শক্তি নষ্ট হয়। পর্যাপ্ত আধুনিক হোটেল ও মোটেল নেই। পর্যটন কেন্দ্রগুলোও অবহেলিত। এগুলোর সুপরিকল্পিত আধুনিকায়ন ও শুল্কমুক্ত বিপণির অভাবও এক্ষেত্রে বড় বাধা।

২। রাজনৈতিক অস্থিরতা : দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে বড় সমস্যা হয়ে থাকছে। ঘন ঘন হরতাল, যখন তখন যথেষ্ট ভাঙচুরের কারণে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয় এবং পর্যটকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। ফলে বিদেশি পর্যটকরা এদেশে ভ্রমণে বিশেষ উৎসাহ বোধ করেন না।

৩। উন্নত সেবা ও তথ্যের অভাব : দক্ষ, মার্জিত জনবলের অভাব শিল্পের একটা বড় সমস্যা। সেই সঙ্গে রয়েছে উন্নত ও দ্রুত তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব।

৪। সামাজিক বাধা : বিদেশি পর্যটকদের সাংস্কৃতিকে এদেশে অনেকেই সহজ ও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। অনেকেই তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। অনেকেই তাদের সম্পর্কে পোষণ করেন নেতিবাচক মনোভাব। অনেক সময় পর্যটকরা দুষ্টলোকের পাল্লায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্থও হন। এগুলোও এ শিল্পের বিকাশে সমস্যা হয়ে আছে।

৫। প্রচারের অভাব : আজকে আমরা বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, বিবিসি, সিএনএন, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যসহ প্রাকৃতিক রূপ অবলোকন করে থাকি। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন কোনো প্রচার নেই বললেই চলে।

৬। নিরাপত্তার অভাব : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, চুরি, ছিনতাই, হত্যা, রাহাজানি, সহিংসতা, পর্যটকদের চলাফেরার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক।

 

পর্যটন শিল্প বিকাশে করণীয়

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ অত্যান্ত সম্ভাবনাময়। এই শিল্পের বিকাশে প্রথমেই সচেষ্ট হতে হবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিরসনে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠায়। পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সংস্কার। চাই স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা। আকর্ষণীয় এলাকাগুলোর পরিকল্পিত নান্দনিক উন্নয়ন যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন পর্যটন কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। পর্যটন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে প্রয়োজন তথ্যপূর্ণ আকর্ষণীয় প্রচার। এই শিল্পের বিকাশের জন্য পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে পর্যটকদের নিরাপত্তা। বিভিন্ন দেশের মতো পর্যটকদের বাড়তি সুবিধা দিতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন করতে হবে। সৈকতে রাখতে হবে বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা, ব্যবহার করতে হবে আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি। প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থানসহ অন্যান্য দৃষ্টিনন্দন স্থানকে পর্যটনের আওতায় এনে সমৃদ্ধ করতে হবে।

 

উপসংহার

পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে আরো উন্নত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ৭ম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাং বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকে সর্বদা ধরে রাখার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশের দায়িত্ব আমাদের। সরকারের পাশাপাশি আমরা বেসরকারি উদ্যোগে বিকাশ ঘটাতে পারি পর্যটন শিল্পের। আমরা সম্মিলিতভাবে যদি প্রচেষ্টা চালাই তাহলে অচিরেই পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিবে।


আরো দেখুন (বাংলা প্রবন্ধ রচনা) :

রচনা : বাংলাদেশের ষড়ঋতু (Class 9 & up)

বাংলাদেশের ষড়ঋতু

↬ ষড়ঋতুর বাংলাদেশ
↬ ঋতুচক্র ও বাংলাদেশ
↬ বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য
↬ রূপসী বাংলা
↬ বাংলাদেশের নিসর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব

 

ভূমিকা

ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক— সকল দেশের সেরা;
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা— দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা ষড়ঋতুর এ বসুন্ধরার রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথায়ও দেখা যায় না। বাংলার প্রকৃতিতে রূপ, রস, গন্ধ অবিরত রং বদলায়। ঋতুবৈচিত্র্যে বাংলার প্রকৃতি সাজে নানান সাজে। অফুরন্ত এ রূপ সর্বদা নব নব সাজে সজ্জিত হয়। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ বৈচিত্র্যময় দেশ কখনো ভৈরবী রূপ নেয়, কখনো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, কখনো সজল কালো চোখ তুলে ভালোবাসার বান ছুঁড়ে দেয় প্রকৃতির সন্তানদের দিকে। কখনো কিশোরী মেয়ের মতো বাঁকা চায়, কখনো যৌবন রসে সিক্ত করে সবাইকে। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার অফুরন্ত রূপ কখনো ফুরিয়ে যায় না।

ষড়ঋতু নাম তো আমাদের সকলেরই জানা। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এক এক ঋতুর এক এক বৈচিত্রের বর্ণনা দেওয়া হলো।

 

রুদ্র গ্রীষ্ম

ঋতুরঙের প্রথম কুশীলব গ্রীষ্ম। ধু ধু রুক্ষ দুই চোখে প্রখর বহ্নিজ্বালা নিয়ে তার আবির্ভাব। সূর্যের প্রচণ্ড শাসনে ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ। প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে। সেই তৃষ্ণাকাতর বিরহের নিরুদ্ধ নিঃশ্বাস উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে অপরাহ্ণে। আদিগন্ত মরুজ্বালার মধ্যে গ্রীষ্ম সন্ধ্যা যেন একটি শ্যামল স্নিগ্ধ মরূদ্যান। কালবোশেখি যে রুদ্রসুন্দর মূর্তি আকাশ মাটির দেহের উত্তাপ মুছে নিতে আসে শুশ্রূষার সুগভীর প্রতিশ্রুতির মতো। যা জীর্ণ ও গতায়ু, তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গ্রীষ্ম নববিধানের দুর্ধর্ষ আশ্বাসবাণী ঘোষণা করে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মের ডালি ভরে ওঠে সুরসাল আম জাম কাঁঠালের প্রাচুর্যে। গ্রীষ্ম ফুলের ঋতু নয়, ফুল ফোটাবার তাড়া নেই তার, শুধু ফলের ডালা সাজিয়েই নিঃশব্দে বিদায় নেয় সে। গ্রীষ্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি সুফিয়া কামাল তাঁর ‘গ্রীষ্ম’ নামক কবিতায় লিখেছেন—

“আমি গ্রীষ্ম। আসিলাম বসন্তের পরিত্যক্ত পথে
ধূসর ঊষর রুক্ষ। ধূলি-ম্লান বহুদূর হতে।
অপেক্ষি’ আমার লাগি কেহ নাহি। শিশিরাশ্রু আঁখি
সিক্ত নব কিশলয়। আমি গ্রীষ্ম পরম একাকী।”

 

নবীন বর্ষা

রূপসী বাংলার বুকে গ্রীষ্মের পর আসে শ্যামল সরস সজল নবীন বর্ষা। গ্রীষ্মের লেলিহান হোমশিখাকে আবৃত করে দূর দিগন্তে ধূসর আকাশের বুকে স্তরে স্তরে জমে ওঠে নবীন মেঘের স্তূপ। এক অপূর্ব সমারোহে আকাশ-বাতাস ব্যাপ্ত করে রাজ রাজেশ্বরের মতো আসে বর্ষা। বর্ষমঞ্চের দ্বিতীয় কুশীলব সে। বর্ষা বাংলাদেশের সবচেয়ে জীবন্ত ঋতু। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ বিকাশ ও গুরুগম্ভীর বজ্রনিনাদের ‘অতি ভৈরব হরষে’র মধ্যে সূচিত হয় তার শুভাগমন। তাই বাংলাদেশের ষড়ঋতু নিয়ে কবিতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতায় বলেছেন—

“ওই আসে ওই          অতি ভৈরব হরষে
জল সিঞ্চিত          ক্ষিতি সৌরভ ভরষে
ঘন গৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা। “

বর্ষার আগমনে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যে বিপুল পরিবর্তন আসে, অন্য কোনো ঋতুতে তা দেখা যায় না। পল্লিপ্রকৃতিতে বর্ষা নিয়ে আসে যৌবনের উদ্দামতা। অবিশ্রান্ত বর্ষণে মাঠঘাট, খালবিল, নদীনালা ভরে যায়। দূর দিগন্ত থেকে দুরন্ত বায়ু ছুটে আসে হা হা শব্দে। শুরু হয় শীতল ধারাবর্ষণ। বহুদিন পরে আবার শোনা যায় নানা সংগীতমুখর পাখির কূজন। মাটির কঠিন শাসন ভেদ করে নবীন শস্যশিশুর দল বেরিয়ে পড়ে নবজীবনের জয়যাত্রায়। প্রকৃতির ধূলি বিষণ্ন অঙ্গ থেকে গ্রীষ্মের ধূসর অবসাদ মুছে গিয়ে ঘনিয়ে আসে সজল বর্ষাপ্রকৃতির পুষ্প বিকাশের পরম লগ্ন।

কদম্ব, কেয়া, জুঁই, গন্ধরাজ, হাস্নাহেনার বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের উৎসবে বাংলার প্রকৃতির হৃদয়ের দ্বার যেন খুলে যায়। তারপর বেজে ওঠে বর্ষা বিদায়ের বিষণ্ন মাদল। শেষ বর্ষণের পালাগান গেয়ে, পথে পথে কদম্ব কেশরের স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে বাংলার পল্লিপ্রকৃতিকে হাসিয়ে কাঁদিয়ে বিদায় গ্রহণ করে রূপময়ী, রসময়ী বর্ষা। এই দৃশ্যের অনুভব থেকেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘চক্রবাক’ কাব্যের ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় বলেছেন—

“ওগো ও জলের দেশের কন্যা! তব ও বিদায়-পথে
কাননে কাননে কদম কেশর ঝরিছে প্রভাত হতে।”

 

অমল ধবল শরৎ

বৈচিত্র্যময় রূপৈশ্বর্যের রানী বাংলার তৃতীয় ঋতু শরৎ। অমল ধবল পালে ছন্দ মধুর হাওয়া লাগিয়ে প্রকৃতিতে আবির্ভাব ঘটে শরতের। বর্ষণক্লান্ত মেঘ তার বারিবর্ষণ মুছে ফেলে লঘুতর রূপ গ্রহণ করে— অলস মন্থর গতিময় ছন্দে আকাশের একাংশ শূন্য করে অন্য অংশে ভেসে যায়। বর্ষার প্রকৃতিকে ধুইয়ে শুদ্ধ কোমল রূপকান্তিতে সাজিয়ে দিয়ে যায়। আর শরত্রানী আলো-আঁধারির লুকোচুরির খেলায় নিজেকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাখে। কাশফুলের শুভ্রতায় প্রকৃতিতে শান্তির পরশ লাগে। শিউলি ফুলের মন উদাস করা গন্ধ মানবমনে ভালোবাসা জাগিয়ে দেয়। ভোরের শিশিরের কোমলতা নিয়ে প্রকৃতি মানবমনে সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়। শরতের রূপে মুগ্ধ কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—

“আজি কী তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে।
হে মাতঃ বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।”

শরতে পৃথিবী যেন সদ্যস্নাতা তরুণীর মূর্তি পরিগ্রহ করে দেখা দেয় অপরূপ মহিমায়। তারই বন্দনায় গাছ থেকে শেফালি ঝরে পড়ে। শরতের মূর্তিতে নিহিত রয়েছে একটি পরিতৃপ্তির হাসি। বাঙালি হিন্দু সমাজের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজার আয়োজনে মুখর হয়ে ওঠে বাংলার গ্রাম ও নগর। তবে শরতের অবসর কম। রাতে তার শেফালি ঝরে যায়, ধানের ক্ষেতে তার সৌন্দর্য পলকে পলকে নতুন হয়, বন-উপবন দোয়েল কোয়েলের। কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।

 

সুমঙ্গলা হেমন্ত

শরত্রানীর বিদায় বার্তা ঘোষিত হতেই হিমের ঘন ঘোমটায় মুখ ঢেকে হেমন্ত এসে উপস্থিত হয়। সে বঙ্গ ঋতুনাট্যের চতুর্থ কুশীলব। হেমন্তের নেই শরতের বনৈশ্বর্য, আছে সুদূর ব্যাপ্ত এক বৈরাগ্যের বিষণ্নতা। সে যেন ফসল ফলানোর নিঃসঙ্গ সাধনায় থাকে নিমগ্ন। ক্ষেতে খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান উঠতে থাকে। চারদিকে অন্তহীন কর্মব্যস্ততা। ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্নের উৎসব। কবি জাহানারা আরজুর ভাষায়—

“চারদিকে মউ মউ নবান্নের ঘ্রাণ—
কার্তিকের সোনা ধানে ভরে যায় গোলা,
হেমন্তের দিনগুলো আসে ঝকঝকে
সোনার থালায় —”

হেমন্ত আবহমান বাংলার এক আনন্দময় উৎসবের ঋতু। হেমন্তের জীবন ত্যাগের মহিমায় প্রোজ্জ্বল। ঘরে ঘরে ফসলের সওগাত বিলিয়ে দেওয়ার জন্য যেন তার আগমন ও অবস্থান। নিজেকে উজাড় করে দেওয়াই যেন তার মহান ব্রত। নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মধ্যেই তার সার্থকতা। নতুন শাক-সবজির পসরা বহন করে আনে মানুষের দুয়ারে। মানুষকে বাঁচানোর উপকরণ হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নেয় হেমন্ত। তাই কবি বলেছেন—

“ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে॥”

 

হাড় কাঁপানো শীত

হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পর আসে জড়াগ্রস্ত শীতের ধূসর বার্ধক্য। শুষ্ক কাঠিন্য, পরিপূর্ণ রিক্ততা ও দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি সে। তার তাপ বিরল রূপমূর্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে এক মহামৌনী তপস্বীর তপশ্চর্যা এবং অনন্ত বৈরাগ্যের ধূসর অঙ্গীকার। বিবর্ণ কানন বীথির পাতায় পাতায় নিঃশেষে ঝরে যাওয়ার নির্মম ডাক এসে পৌছায়। এক সীমাহীন রিক্ততায় অসহায় ডালপালাগুলো একদিন হাহাকার করে কেঁদে ওঠে। তাকে সব দিয়ে দিতে হয়, দিয়ে যেতে হয়। ওদিকে, ধান কাটা মাঠে কী সীমাহীন শূন্যতা, বিশাল কারুণ্য। ত্যাগের কী অপরূপ মহিমা! হেমন্তে যে নবান্নের উৎসব শুরু হয়, তার অবসান ঘটে হাড়কাঁপা শীতের শাসানিতে। শীতের আগমনের সাথে সাথে প্রকৃতির ওপর যে শাসন ও শোষণ শুরু হয়ে যায়, তাতে প্রকৃতি তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে রুক্ষ হয়ে ওঠে। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন—

“ওগো শীত, ওগো শুভ্র, হে তীব্র নির্মম,
তোমার উত্তর বায়ু দুরন্ত দুর্দম
অরণ্যের বক্ষ হানে। বনস্পতি যত
থরথর কম্পমান, শীর্ষ করি নত
আদেশ-নির্ঘোষ তব মানে।”

 

নবজীবন বসন্ত

ঋতুচক্রের সর্বশেষ ঋতু বসন্ত। শীতের ত্যাগের সাধনা তো বসন্তের নবজন্মের প্রতীক্ষায়ই। বসন্ত আসে নবীন প্রাণ, নবীন উৎসাহ, নবীন উদ্দীপনা নিয়ে, যৌবনের সঞ্জীবনী রসে পরিপুষ্ট হয়ে। তার সুখময় স্পর্শে গাছে গাছে জেগে ওঠে কিশলয়। পাখির কলকাকলিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। দূর বনান্তরাল থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহুগীতি পৃথিবীতে সৃষ্টি করে এক অপরূপ মায়া নিকেতন অশোক পলাশের রঙিন বিহ্বলতায় ও শিমুল কৃষ্ণচূড়ার বিপুল উল্লাসে, মধুমালতী ও মাধবী মঞ্জরীর উচ্ছল গন্ধমদির প্রগলভতায় সারা আকাশতলে গন্ধ, বর্ণ ও গানের তুমুল কোলাহলে লেগে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি। বসন্তকালে গাছে গাছে নানা ফুল ফোটে। তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই কবি বসন্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন—

“হে বসন্ত, হে সুন্দর, ধরণীর ধ্যানভরা ধন, বৎসরের শেষে।
শুধু একবার মর্ত্যে মূর্তি ধরো ভুবনমোহন নব বরবেশে৷”

 

উপসংহার

রূপসী বাংলার এই ঋতুরঙ্গমালা নানা বর্ণ, গন্ধ, গানের সমারোহে নিত্য আবর্তিত হয়ে চলে। ষড়ঋতুর রঙ্গমঞে এমনি করে প্রতিটি ঋতু যুগ যুগ ধরে অভিনয় করে যাচ্ছে। একের পর এক তাদের আগমন ও অন্তর্ধান বাঙালির প্রাণে রঙ ধরায়। এই ঋতুচক্রের অবদানেই আমাদের বাংলাদেশ হয়েছে সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা এবং অরণ্যকুন্তলা।