মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশ
ভূমিকা
বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু এই স্বাধীনতা পেতে বাঙালিকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। টানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাঙালি পায় তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা। এই যুদ্ধ ছিল বাঙালির মুক্তির পূর্বশর্ত বাঙালির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ৭ কোটি মানুষের অধিকার রক্ষার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে বাঙালি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ও লাখো বীরাঙ্গনার সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে ১৯৭১ সালে উদিত হয় স্বাধীনতার লাল সূর্য। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিকামী মানুষ হারিয়েছে অনেক কিছু। সর্বস্ব হারিয়েও তারা অর্জন করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম স্বপ্নের একটি বাংলাদেশ।
প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের দুইটি অংশ ছিল যার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যেমন ছিল দূরত্বের ফারাক তেমনি অধিকারের দিক থেকেও ছিল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক তফাৎ। তৎকালীন পাকিস্তান তথা বর্তমানের বাংলাদেশের মানুষের উপর প্রথম থেকেই পাকিস্তানিরা অত্যাচারের স্টিম রোলা চালাতে থাকে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হতে থাকে সম্পদ। পূর্ব বাংলায় দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ে শুরু হয় বৈষম্য। তাছাড়া বাঙালির নানান অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হতে থাকে। ফলে সারা দেশে এক বিরাট বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় যা পরবর্তিতে আন্দোলনে রূপ নেয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ
বাঙালির জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রিভাষা ঘোষণা করলে রাজপথে নামে ছাত্র জনতা। তখন তাদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। শহিদ হয় সালাম বরকত রফিক জব্বার শফিকসহ নাম না জানা অনেকে। এর মধ্য দিয়ে প্রথম অধিকারের আঘাত আনে তারা ভাষার উপর। এরপর ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে তারা আমাদেরকে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর ১৯৬৬ এর ছয় দফা ও ১৯৬৯ এর গণঅভূত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি বুঝতে পারে যে যুদ্ধ ছাড়া এই দেশে বাঙালিরা তাদের অধিকার পাবে না। তাই তখন থেকেই মানুষের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে এবং মনে মনে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
স্বাধীনতার ডাক
১৯৬৯ সালের গনঅভূত্থানের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন এদেশকে স্বাধীন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এদেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে। তাই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ডাক দেন। এই ভাষণ ৭ই মার্চের ঐতিহাসির ভাষণ নামে পরিচিত। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনগণকে যা কিছু আছে তা নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আদেশ দেন। সেই ভাষণই ছিল বাঙালির দেশ স্বাধীন করার মূল প্রেরণা। সেই ভাষণে ছিল যুদ্ধের সকল দিকনির্দেশনা। তিনি বলেন-
রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
২৫শে মার্চের কালরাত্রি
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের পর জনগণের মধ্যে দেখা দেয় স্বাধিকার চেতনা। সকলে সংগ্রামী মনোভাব দেখাতে শুরু করে। তখন পাকিস্তানিরা বাঙালিকে দমাতে নতুন পরিকল্পনা করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসে অস্ত্রধারী ট্যাঙ্ক ও গোলাবারুদ। ২৫ শে মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। সেদিন এক রাতে ঢাকায় প্রায় ২০ হাজার মানুষকে নিরীহভাবে হত্যা করা হয়। অবস্থা বুঝতে পেরে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাকে সেখানেই বন্দি করে রাখা হয়।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ
২৫শে মার্চের সেই নারকীয় হত্যার পরই বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ মর্ম বুঝতে পারে। তাই ২৬ শে মার্চ থেকেই সকল বাঙালি যে যা পারে তাই নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ঝাপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিকেরা। তাছাড়া তৎকালীন বাঙালী পুলিশ ইপিআর আনসার বাহিনীরাও একযোগে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। অনেকে সাহসী বাঙালী তরুণেরা দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। তাদের সাথে যোগ দেয় যোগ দেয় স্কুল কলেজের ছাত্র ও দিনমজুর কৃষক ও শ্রমিকেরা।
মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হবার পর জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে মুক্তিবাহিনী। প্রথমে এর সংখ্যা ছিল ১৩০০০। তারপর দলে দলে বাংলার সাহসী তরুণেরা অংশগ্রহণ করতে থাকে। জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার চিফ ইন চার্জ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় নিয়মিত বাহিনী ও অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর অধীনে সারা দেশে তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠন করা হয় যা কে ফোর্স জেড ফোর্স ও এস ফোর্স নামে পরিচিত। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার জন্য দেশেকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত বাহিনী সাফল্যের সাথে যুদ্ধ করে যায়। অতঃপর জুন মাসে অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১০ নং সেক্টরের অধীনে থাকা নৌ কমান্ডো বাহিনীও অত্যন্ত বীরত্ব ও কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করে।
মুজিবনগর সরকার গঠন
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠণ করা হয় যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ ইউনিয়নের আমবাগানে এই সরকার শপথ গ্রহণ করে। এই দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সেই সরকার কাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে মেহেরপুর জেলার ঐ জায়গাটিকে মুজিবনগর নামে নামকরণ করা হয়।
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুজিবনগর সরকারের প্রধান কাজই ছিল বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা। মুজিবনগর সরকারের দেশে ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। মুজিবনগর সরকার মুক্তিবাহিনীর সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ ও বিদেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এ সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের মতো বিরূপ পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বজায় রাখা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ যা এই সরকার খুব ভালোভাবে পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণ ও পেশাজীবীদের ভূমিকা
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল বাংলার সাধারণ জনগণ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারা একযোগে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। দেশের ছাত্র জনতা পুলিশ ইপিআর কৃষক শ্রমিক পেশাজীবী সকলেই মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেকে দিয়েছে নিজেদের প্রাণ আবার অনেকে পঙ্গু অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই ঋণ কোনোদিনও শোধ করা যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের সকল মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। তাই একে গনযুদ্ধ বা জনযুদ্ধও বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুক্তিযোদ্ধারাই ছিলেন আসল দেশপ্রেমিক। তারা ছিলেন অসীম সাহসী, দেশের বীর সন্তান ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ যোদ্ধা। নিজেদের জানের মায়া ত্যাগ করে তারা দেশকে স্বাধীন করেছিল। তাদের এই ত্যাগ জাতি চিরকাল স্মরণে রাখবে।
মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নেতৃত্বদানকারী দলটির নাম হলো আওয়ামী লীগ। মূলত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বই মুক্তিযুদ্ধের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে। তারা ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধিকার চেতনার জাগরণ ঘটায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেকগুলো রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:ন্যাপ(ভাসানী) ন্যাপ(মোজাফফর) কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসস ইত্যাদি। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিছু দল পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রাজাকার আলবদর আল শামস ইত্যাদি। তারা হত্যা লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ সহ নানান ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেখানে ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। গোটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল।
স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব ছাত্র জনতা। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়। পাকিস্তানি আমলে প্রতিটি আন্দোলনের মূল আহবায়ক ছিল ছাত্ররাই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তারাই নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। এরপর ১৯৫৪ ১৯৬৬ ১৯৬৯ ১৯৭০ এর প্রতিটি আন্দোলনেই তারা রেখেছিল সক্রিয় ভূমিক। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র জনতা ভ্যানগার্ড নামে অধিক পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে দেশের আনাচে কানাচে থেকে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা একযোগে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। অনেক শিক্ষার্থীরা বাবা-মা কে লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সাথে। তারা চলে যায় সিমান্ত পেরিয়ে পাশের দেশ ভারতে। সেখানে গিয়ে তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ও গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা নাজেহাল করে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে নারীরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অনেক নারীরাই প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি রণাঙ্গনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন নিজের জীবন বাজি রেখে। নারীরা কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে আবার কখনো যুদ্ধেক্ষেত্রের আড়ালে। তারা সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়েছেন প্রেরণা দিয়েছেন অচেনা অজানা অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা সুশ্রুষা করেছেন। নিজেরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করেছেন। অনাহারী অর্ধাহারী ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা কখনো সেবা দিয়েছেন নিজের বোনের মতো কখনো মায়ের মতো। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে নিজেদের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য নারীরা তেমন কোনো বিশেষ স্বীকৃতি পাননি। অনেক নারীযোদ্ধারাই হারিয়ে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে ও অনুপ্রেরণা জোগাতে এবং জনগণের মনে আধার সঞ্চার করতে ও দেশে বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে দেশ বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয় অসংখ্য নিয়মিত এবং অনিয়মিত পত্রিকা। এসব পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার বীরসেনাদের সাহসীকতার চিত্র এবং পাকবাহিনীর ধ্বংসলীলার দৃশ্য। পত্রিকাগুলোতে এ সম্পর্কে লেখা হতো বিভিন্ন প্রবন্ধ ছড়া রচনা কবিতা গল্প গান কার্টুন ইত্যাদি। সেই সময়ে লেখা সেই পত্রিকাগুলো আজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোতেও বাঙালির বীরত্ব সাহসিকতা পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে অবস্থানকারী বাঙালিরাও বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। মূলত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা সরবরাহকারী বাহিনীর ভূমিকায় কাজ করছেন। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে ছুটে গিয়েছেন। এছাড়াও তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে। পাকিস্তানকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ না করার জন্য বিভিন্ন প্রবাসী সরকারের নিকট আবেদন করেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের ক্ষেত্রেও তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ছিল জনগণ। তবে দেশের শিল্পী সাহিত্যিকরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়।মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের পত্র পত্রিকায় লেখা বেতার কেন্দ্রের খবর পাঠ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা বিভিন্ন ধরণের দেশাত্মবোধক গান ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান কবিতা নাটক কথিকা ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বজায় রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্র ও জল্লাদের দরবার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অনুপ্রাণিত করেছিল। এককথায় দেশের সকল বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে এবং জনগণকে শত্রুর নিকট দুর্দমনীয় করে তুলেছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের চিত্র বিশ্বের সকল গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ হতে থাকলে সকল রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত তখন প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করতে এগিয়ে আসেন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারতের বাহিনীরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সমর্থন দিলেও মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের বিরোধিতা করে। কিন্তু সেই দেশের সাধারণ জনগণের তোপের মুখে পড়ে মার্কিন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও ভারতের রভি শংকর কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর আয়োজন করে এবং প্রাপ্ত টাকা বাংলাদেশকে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে।
মুক্তিযুদ্ধে যৌথ বাহিনী
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ২১ নভেম্বর ভারতের কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমান্ডো। ভারতীয় সেই বাহিনী মিত্রবাহিনী নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীকে অচল করে দেয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী গভীর রাতে বাংলাদেশের সকল রুটে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানের প্রতিটি বিমানঘাটিতে হামলা চালায়। কুর্মিটোলা বিমানঘাটিতে ৫০ টন বোমা ফেলা হয়। তাদের আক্রমণে পাকিস্তানের প্রায় এক ডজনের মতো বিমান বিদ্ধস্ত হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশের সশস্ত্র যোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা নাজেহাল হয়ে পড়ে। তখন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত অধ্যায়। ভারতীয় যোদ্ধাদের সাথে এক হয়ে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীর মনোবল বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক ভারতীয় সেনা মৃত্যুবরণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে যখন মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি করার পদক্ষেপ নেয়। তারা তখন ঝাপিয়ে পড়ে আমাদের দেশের সূর্যসন্তানদের উপর। আর এই কাজে তাদেরকে সাহায্য করেছিল এদেশের এদেশের দোসর রাজাকার আলবদর ও আল শামস বাহিনী। তারা রাতের অন্ধকারে এদেশের মুক্তিকামী ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী সকল শিক্ষক চিকিৎসক ডাক্তার সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাদের অনেকেরই ক্ষতবিক্ষত দেহ ঢাকার রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ
মাত্র নয় মাসের যুদ্ধেই পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যৌথবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমনে পাকিস্তানি বাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়ে। তার আর কোনো উপায় না পেয়ে হানাদার পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথ কমান্ডো এর পক্ষে লে জে জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে লে জে নিয়াজী পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতিকে শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি প্রদান করেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে শত বছরের বাঙালি পরিচয়কে প্রধান্য দিয়ে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই ঐক্য দেশ গঠনে এবং এর উন্নয়নে বাঙালিজাতিকে নতুন উদ্যম প্রদান করে। দেশপ্রেম এবং জাতীয় সঙ্ঘতি একত্রে অত্যাবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই পরে আমাদের সব বিভেদ ভুলে দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসেবে লাল সবুজ পতাকার তলে সমবেত করতে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
বাংলাদেশের মানুষের যে স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার মানসে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাধীনতার পর বারবার সরকার বদল হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী তৎপরতা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য যুবসমাজে সৃষ্ট হতাশা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘুষ দুর্নীতি ইত্যাদি কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাজে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ। এ লক্ষ্যে দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাঁথা আর আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। যে আদর্শ উদ্দেশ্য ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তাদের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে ইজ্জত দিয়েছে হাজার হাজার মা বোন আমাদের সমাজ এবং জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ ও চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে এটিই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও দায়িত্ববোধ
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে আমাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাই বর্তমানে এই স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টা বাস্তবায়ন করতে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে। দেশের সকল জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যেন তারা দেশের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। দেশের সকল দেশপ্রেমিক শিল্পপতি চাকরিজীবী ব্যবসায়ী বুদ্ধিজীবী ও সকল কর্মকার্তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে সকল বিরোধের ঊর্ধে থেকে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। দেশকে একটি দারিদ্রমুক্ত সুশিক্ষিত ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।
উপসংহার
স্বাধীনতা যে মানুষের জন্মগত অধিকার বাংলাদেশের মানুষ তা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম এই স্বাধীনতা। এর মাধ্যমে অবসান ঘটেছিল পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছরের শাসন শোষণ ও নিপীড়নের। তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমরা এখনো বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা গড়তে পারিনি। স্বাধীন জাতি হয়েও স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ এখনো আমরা পাইনি। তাই সকল সংকটকে দূরে ঠেলে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের নিজেরদেরকে দেশপ্রেম কর্তব্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই আমরা রক্ষা করতে পারব আমাদের স্বাধীনতাকে।