Category Archives: মুক্তিযুদ্ধ

রচনা: মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশ [২৪ পয়েন্ট]

মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশ

ভূমিকা

বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু এই স্বাধীনতা পেতে বাঙালিকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। টানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাঙালি পায় তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা। এই যুদ্ধ ছিল বাঙালির মুক্তির পূর্বশর্ত বাঙালির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ৭ কোটি মানুষের অধিকার রক্ষার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে বাঙালি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ও লাখো বীরাঙ্গনার সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে ১৯৭১ সালে উদিত হয় স্বাধীনতার লাল সূর্য। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিকামী মানুষ হারিয়েছে অনেক কিছু। সর্বস্ব হারিয়েও তারা অর্জন করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম স্বপ্নের একটি বাংলাদেশ।

 

প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের দুইটি অংশ ছিল যার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যেমন ছিল দূরত্বের ফারাক তেমনি অধিকারের দিক থেকেও ছিল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক তফাৎ। তৎকালীন পাকিস্তান তথা বর্তমানের বাংলাদেশের মানুষের উপর প্রথম থেকেই পাকিস্তানিরা অত্যাচারের স্টিম রোলা চালাতে থাকে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হতে থাকে সম্পদ। পূর্ব বাংলায় দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ে শুরু হয় বৈষম্য। তাছাড়া বাঙালির নানান অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হতে থাকে। ফলে সারা দেশে এক বিরাট বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় যা পরবর্তিতে আন্দোলনে রূপ নেয়।

 

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ

বাঙালির জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রিভাষা ঘোষণা করলে রাজপথে নামে ছাত্র জনতা। তখন তাদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। শহিদ হয় সালাম বরকত রফিক জব্বার শফিকসহ নাম না জানা অনেকে। এর মধ্য দিয়ে প্রথম অধিকারের আঘাত আনে তারা ভাষার উপর। এরপর ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে তারা আমাদেরকে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর ১৯৬৬ এর ছয় দফা ও ১৯৬৯ এর গণঅভূত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি বুঝতে পারে যে যুদ্ধ ছাড়া এই দেশে বাঙালিরা তাদের অধিকার পাবে না। তাই তখন থেকেই মানুষের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে এবং মনে মনে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।

 

স্বাধীনতার ডাক

১৯৬৯ সালের গনঅভূত্থানের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন এদেশকে স্বাধীন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এদেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে। তাই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ডাক দেন। এই ভাষণ ৭ই মার্চের ঐতিহাসির ভাষণ নামে পরিচিত। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনগণকে যা কিছু আছে তা নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আদেশ দেন। সেই ভাষণই ছিল বাঙালির দেশ স্বাধীন করার মূল প্রেরণা। সেই ভাষণে ছিল যুদ্ধের সকল দিকনির্দেশনা। তিনি বলেন-

রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

 

২৫শে মার্চের কালরাত্রি

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের পর জনগণের মধ্যে দেখা দেয় স্বাধিকার চেতনা। সকলে সংগ্রামী মনোভাব দেখাতে শুরু করে। তখন পাকিস্তানিরা বাঙালিকে দমাতে নতুন পরিকল্পনা করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসে অস্ত্রধারী ট্যাঙ্ক ও গোলাবারুদ। ২৫ শে মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। সেদিন এক রাতে ঢাকায় প্রায় ২০ হাজার মানুষকে নিরীহভাবে হত্যা করা হয়। অবস্থা বুঝতে পেরে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাকে সেখানেই বন্দি করে রাখা হয়।

 

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ

২৫শে মার্চের সেই নারকীয় হত্যার পরই বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ মর্ম বুঝতে পারে। তাই ২৬ শে মার্চ থেকেই সকল বাঙালি যে যা পারে তাই নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ঝাপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিকেরা। তাছাড়া তৎকালীন বাঙালী পুলিশ ইপিআর আনসার বাহিনীরাও একযোগে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। অনেকে সাহসী বাঙালী তরুণেরা দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। তাদের সাথে যোগ দেয় যোগ দেয় স্কুল কলেজের ছাত্র ও দিনমজুর কৃষক ও শ্রমিকেরা।

 

মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হবার পর জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে মুক্তিবাহিনী। প্রথমে এর সংখ্যা ছিল ১৩০০০। তারপর দলে দলে বাংলার সাহসী তরুণেরা অংশগ্রহণ করতে থাকে। জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার চিফ ইন চার্জ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় নিয়মিত বাহিনী ও অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর অধীনে সারা দেশে তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠন করা হয় যা কে ফোর্স জেড ফোর্স ও এস ফোর্স নামে পরিচিত। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার জন্য দেশেকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত বাহিনী সাফল্যের সাথে যুদ্ধ করে যায়। অতঃপর জুন মাসে অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১০ নং সেক্টরের অধীনে থাকা নৌ কমান্ডো বাহিনীও অত্যন্ত বীরত্ব ও কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করে।

 

মুজিবনগর সরকার গঠন

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠণ করা হয় যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ ইউনিয়নের আমবাগানে এই সরকার শপথ গ্রহণ করে। এই দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সেই সরকার কাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে মেহেরপুর জেলার ঐ জায়গাটিকে মুজিবনগর নামে নামকরণ করা হয়।

 

মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুজিবনগর সরকারের প্রধান কাজই ছিল বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা। মুজিবনগর সরকারের দেশে ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। মুজিবনগর সরকার মুক্তিবাহিনীর সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ ও বিদেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এ সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের মতো বিরূপ পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বজায় রাখা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ যা এই সরকার খুব ভালোভাবে পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণ ও পেশাজীবীদের ভূমিকা

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল বাংলার সাধারণ জনগণ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারা একযোগে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। দেশের ছাত্র জনতা পুলিশ ইপিআর কৃষক শ্রমিক পেশাজীবী সকলেই মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেকে দিয়েছে নিজেদের প্রাণ আবার অনেকে পঙ্গু অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই ঋণ কোনোদিনও শোধ করা যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের সকল মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। তাই একে গনযুদ্ধ বা জনযুদ্ধও বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুক্তিযোদ্ধারাই ছিলেন আসল দেশপ্রেমিক। তারা ছিলেন অসীম সাহসী, দেশের বীর সন্তান ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ যোদ্ধা। নিজেদের জানের মায়া ত্যাগ করে তারা দেশকে স্বাধীন করেছিল। তাদের এই ত্যাগ জাতি চিরকাল স্মরণে রাখবে।

 

মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নেতৃত্বদানকারী দলটির নাম হলো আওয়ামী লীগ। মূলত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বই মুক্তিযুদ্ধের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে। তারা ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধিকার চেতনার জাগরণ ঘটায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেকগুলো রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:ন্যাপ(ভাসানী) ন্যাপ(মোজাফফর) কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসস ইত্যাদি। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিছু দল পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রাজাকার আলবদর আল শামস ইত্যাদি। তারা হত্যা লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ সহ নানান ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেখানে ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। গোটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল।
স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব ছাত্র জনতা। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়। পাকিস্তানি আমলে প্রতিটি আন্দোলনের মূল আহবায়ক ছিল ছাত্ররাই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তারাই নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। এরপর ১৯৫৪ ১৯৬৬ ১৯৬৯ ১৯৭০ এর প্রতিটি আন্দোলনেই তারা রেখেছিল সক্রিয় ভূমিক। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র জনতা ভ্যানগার্ড নামে অধিক পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে দেশের আনাচে কানাচে থেকে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা একযোগে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। অনেক শিক্ষার্থীরা বাবা-মা কে লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সাথে। তারা চলে যায় সিমান্ত পেরিয়ে পাশের দেশ ভারতে। সেখানে গিয়ে তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ও গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা নাজেহাল করে তোলে।

 

মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে নারীরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অনেক নারীরাই প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি রণাঙ্গনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন নিজের জীবন বাজি রেখে। নারীরা কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে আবার কখনো যুদ্ধেক্ষেত্রের আড়ালে। তারা সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়েছেন প্রেরণা দিয়েছেন অচেনা অজানা অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা সুশ্রুষা করেছেন। নিজেরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করেছেন। অনাহারী অর্ধাহারী ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা কখনো সেবা দিয়েছেন নিজের বোনের মতো কখনো মায়ের মতো। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে নিজেদের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য নারীরা তেমন কোনো বিশেষ স্বীকৃতি পাননি। অনেক নারীযোদ্ধারাই হারিয়ে গেছেন।

 

মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে ও অনুপ্রেরণা জোগাতে এবং জনগণের মনে আধার সঞ্চার করতে ও দেশে বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে দেশ বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয় অসংখ্য নিয়মিত এবং অনিয়মিত পত্রিকা। এসব পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার বীরসেনাদের সাহসীকতার চিত্র এবং পাকবাহিনীর ধ্বংসলীলার দৃশ্য। পত্রিকাগুলোতে এ সম্পর্কে লেখা হতো বিভিন্ন প্রবন্ধ ছড়া রচনা কবিতা গল্প গান কার্টুন ইত্যাদি। সেই সময়ে লেখা সেই পত্রিকাগুলো আজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোতেও বাঙালির বীরত্ব সাহসিকতা পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে অবস্থানকারী বাঙালিরাও বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। মূলত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা সরবরাহকারী বাহিনীর ভূমিকায় কাজ করছেন। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে ছুটে গিয়েছেন। এছাড়াও তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে। পাকিস্তানকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ না করার জন্য বিভিন্ন প্রবাসী সরকারের নিকট আবেদন করেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের ক্ষেত্রেও তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

 

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ছিল জনগণ। তবে দেশের শিল্পী সাহিত্যিকরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়।মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের পত্র পত্রিকায় লেখা বেতার কেন্দ্রের খবর পাঠ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা বিভিন্ন ধরণের দেশাত্মবোধক গান ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান কবিতা নাটক কথিকা ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বজায় রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্র ও জল্লাদের দরবার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অনুপ্রাণিত করেছিল। এককথায় দেশের সকল বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে এবং জনগণকে শত্রুর নিকট দুর্দমনীয় করে তুলেছে।

 

মুক্তিযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের চিত্র বিশ্বের সকল গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ হতে থাকলে সকল রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত তখন প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করতে এগিয়ে আসেন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারতের বাহিনীরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সমর্থন দিলেও মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের বিরোধিতা করে। কিন্তু সেই দেশের সাধারণ জনগণের তোপের মুখে পড়ে মার্কিন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও ভারতের রভি শংকর কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর আয়োজন করে এবং প্রাপ্ত টাকা বাংলাদেশকে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে।

 

মুক্তিযুদ্ধে যৌথ বাহিনী

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ২১ নভেম্বর ভারতের কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমান্ডো। ভারতীয় সেই বাহিনী মিত্রবাহিনী নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীকে অচল করে দেয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী গভীর রাতে বাংলাদেশের সকল রুটে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানের প্রতিটি বিমানঘাটিতে হামলা চালায়। কুর্মিটোলা বিমানঘাটিতে ৫০ টন বোমা ফেলা হয়। তাদের আক্রমণে পাকিস্তানের প্রায় এক ডজনের মতো বিমান বিদ্ধস্ত হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশের সশস্ত্র যোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা নাজেহাল হয়ে পড়ে। তখন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত অধ্যায়। ভারতীয় যোদ্ধাদের সাথে এক হয়ে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীর মনোবল বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক ভারতীয় সেনা মৃত্যুবরণ করেন।

 

মুক্তিযুদ্ধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে যখন মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি করার পদক্ষেপ নেয়। তারা তখন ঝাপিয়ে পড়ে আমাদের দেশের সূর্যসন্তানদের উপর। আর এই কাজে তাদেরকে সাহায্য করেছিল এদেশের এদেশের দোসর রাজাকার আলবদর ও আল শামস বাহিনী। তারা রাতের অন্ধকারে এদেশের মুক্তিকামী ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী সকল শিক্ষক চিকিৎসক ডাক্তার সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাদের অনেকেরই ক্ষতবিক্ষত দেহ ঢাকার রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।

 

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ

মাত্র নয় মাসের যুদ্ধেই পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যৌথবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমনে পাকিস্তানি বাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়ে। তার আর কোনো উপায় না পেয়ে হানাদার পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথ কমান্ডো এর পক্ষে লে জে জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে লে জে নিয়াজী পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।

 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতিকে শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি প্রদান করেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে শত বছরের বাঙালি পরিচয়কে প্রধান্য দিয়ে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই ঐক্য দেশ গঠনে এবং এর উন্নয়নে বাঙালিজাতিকে নতুন উদ্যম প্রদান করে। দেশপ্রেম এবং জাতীয় সঙ্ঘতি একত্রে অত্যাবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই পরে আমাদের সব বিভেদ ভুলে দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসেবে লাল সবুজ পতাকার তলে সমবেত করতে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

 

সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

বাংলাদেশের মানুষের যে স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার মানসে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাধীনতার পর বারবার সরকার বদল হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী তৎপরতা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য যুবসমাজে সৃষ্ট হতাশা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘুষ দুর্নীতি ইত্যাদি কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাজে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ। এ লক্ষ্যে দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাঁথা আর আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। যে আদর্শ উদ্দেশ্য ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তাদের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে ইজ্জত দিয়েছে হাজার হাজার মা বোন আমাদের সমাজ এবং জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ ও চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে এটিই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।

 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও দায়িত্ববোধ

 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে আমাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাই বর্তমানে এই স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টা বাস্তবায়ন করতে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে। দেশের সকল জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যেন তারা দেশের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। দেশের সকল দেশপ্রেমিক শিল্পপতি চাকরিজীবী ব্যবসায়ী বুদ্ধিজীবী ও সকল কর্মকার্তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে সকল বিরোধের ঊর্ধে থেকে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। দেশকে একটি দারিদ্রমুক্ত সুশিক্ষিত ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।

 

উপসংহার

 

স্বাধীনতা যে মানুষের জন্মগত অধিকার বাংলাদেশের মানুষ তা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম এই স্বাধীনতা। এর মাধ্যমে অবসান ঘটেছিল পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছরের শাসন শোষণ ও নিপীড়নের। তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমরা এখনো বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা গড়তে পারিনি। স্বাধীন জাতি হয়েও স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ এখনো আমরা পাইনি। তাই সকল সংকটকে দূরে ঠেলে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের নিজেরদেরকে দেশপ্রেম কর্তব্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই আমরা রক্ষা করতে পারব আমাদের স্বাধীনতাকে।

রচনা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসিক প্রেক্ষাপট [24 Point] – PDF

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ভূমিকা

বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু এই স্বাধীনতা পেতে বাঙালিকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। টানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাঙালি পায় তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা। এই যুদ্ধ ছিল বাঙালির মুক্তির পূর্বশর্ত বাঙালির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ৭ কোটি মানুষের অধিকার রক্ষার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে বাঙালি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ও লাখো বীরাঙ্গনার সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে ১৯৭১ সালে উদিত হয় স্বাধীনতার লাল সূর্য। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিকামী মানুষ হারিয়েছে অনেক কিছু। সর্বস্ব হারিয়েও তারা অর্জন করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম স্বপ্নের একটি বাংলাদেশ।

 

প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের দুইটি অংশ ছিল যার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যেমন ছিল দূরত্বের ফারাক তেমনি অধিকারের দিক থেকেও ছিল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক তফাৎ। তৎকালীন পাকিস্তান তথা বর্তমানের বাংলাদেশের মানুষের উপর প্রথম থেকেই পাকিস্তানিরা অত্যাচারের স্টিম রোলা চালাতে থাকে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হতে থাকে সম্পদ। পূর্ব বাংলায় দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ে শুরু হয় বৈষম্য। তাছাড়া বাঙালির নানান অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হতে থাকে। ফলে সারা দেশে এক বিরাট বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় যা পরবর্তিতে আন্দোলনে রূপ নেয়।

 

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ

বাঙালির জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রিভাষা ঘোষণা করলে রাজপথে নামে ছাত্র জনতা। তখন তাদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। শহিদ হয় সালাম বরকত রফিক জব্বার শফিকসহ নাম না জানা অনেকে। এর মধ্য দিয়ে প্রথম অধিকারের আঘাত আনে তারা ভাষার উপর। এরপর ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে তারা আমাদেরকে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর ১৯৬৬ এর ছয় দফা ও ১৯৬৯ এর গণঅভূত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি বুঝতে পারে যে যুদ্ধ ছাড়া এই দেশে বাঙালিরা তাদের অধিকার পাবে না। তাই তখন থেকেই মানুষের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে এবং মনে মনে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।

 

স্বাধীনতার ডাক

১৯৬৯ সালের গণঅভূত্থানের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন এদেশকে স্বাধীন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এদেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে। তাই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ডাক দেন। এই ভাষণ ৭ই মার্চের ঐতিহাসির ভাষণ নামে পরিচিত। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনগণকে যা কিছু আছে তা নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আদেশ দেন। সেই ভাষণই ছিল বাঙালির দেশ স্বাধীন করার মূল প্রেরণা। সেই ভাষণে ছিল যুদ্ধের সকল দিকনির্দেশনা। তিনি বলেন-

রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

 

২৫শে মার্চের কালরাত্রি

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের পর জনগণের মধ্যে দেখা দেয় স্বাধিকার চেতনা। সকলে সংগ্রামী মনোভাব দেখাতে শুরু করে। তখন পাকিস্তানিরা বাঙালিকে দমাতে নতুন পরিকল্পনা করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসে অস্ত্রধারী ট্যাঙ্ক ও গোলাবারুদ। ২৫ শে মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। সেদিন এক রাতে ঢাকায় প্রায় ২০ হাজার মানুষকে নিরীহভাবে হত্যা করা হয়। অবস্থা বুঝতে পেরে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাকে সেখানেই বন্দি করে রাখা হয়।

 

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ

২৫শে মার্চের সেই নারকীয় হত্যার পরই বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ মর্ম বুঝতে পারে। তাই ২৬ শে মার্চ থেকেই সকল বাঙালি যে যা পারে তাই নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ঝাপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিকেরা। তাছাড়া তৎকালীন বাঙালী পুলিশ ইপিআর আনসার বাহিনীরাও একযোগে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। অনেকে সাহসী বাঙালী তরুণেরা দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। তাদের সাথে যোগ দেয় যোগ দেয় স্কুল কলেজের ছাত্র ও দিনমজুর কৃষক ও শ্রমিকেরা।

 

মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হবার পর জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে মুক্তিবাহিনী। প্রথমে এর সংখ্যা ছিল ১৩০০০। তারপর দলে দলে বাংলার সাহসী তরুণেরা অংশগ্রহণ করতে থাকে। জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার চিফ ইন চার্জ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় নিয়মিত বাহিনী ও অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর অধীনে সারা দেশে তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠন করা হয় যা কে ফোর্স জেড ফোর্স ও এস ফোর্স নামে পরিচিত। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার জন্য দেশেকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত বাহিনী সাফল্যের সাথে যুদ্ধ করে যায়। অতঃপর জুন মাসে অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১০ নং সেক্টরের অধীনে থাকা নৌ কমান্ডো বাহিনীও অত্যন্ত বীরত্ব ও কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করে।

 

মুজিবনগর সরকার গঠন

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠণ করা হয় যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ ইউনিয়নের আমবাগানে এই সরকার শপথ গ্রহণ করে। এই দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সেই সরকার কাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে মেহেরপুর জেলার ঐ জায়গাটিকে মুজিবনগর নামে নামকরণ করা হয়।

 

মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুজিবনগর সরকারের প্রধান কাজই ছিল বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা। মুজিবনগর সরকারের দেশে ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। মুজিবনগর সরকার মুক্তিবাহিনীর সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ ও বিদেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এ সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের মতো বিরূপ পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বজায় রাখা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ যা এই সরকার খুব ভালোভাবে পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণ ও পেশাজীবীদের ভূমিকা

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল বাংলার সাধারণ জনগণ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারা একযোগে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। দেশের ছাত্র জনতা পুলিশ ইপিআর কৃষক শ্রমিক পেশাজীবী সকলেই মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেকে দিয়েছে নিজেদের প্রাণ আবার অনেকে পঙ্গু অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই ঋণ কোনোদিনও শোধ করা যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের সকল মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। তাই একে গনযুদ্ধ বা জনযুদ্ধও বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুক্তিযোদ্ধারাই ছিলেন আসল দেশপ্রেমিক। তারা ছিলেন অসীম সাহসী, দেশের বীর সন্তান ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ যোদ্ধা। নিজেদের জানের মায়া ত্যাগ করে তারা দেশকে স্বাধীন করেছিল। তাদের এই ত্যাগ জাতি চিরকাল স্মরণে রাখবে।

 

মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নেতৃত্বদানকারী দলটির নাম হলো আওয়ামী লীগ। মূলত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বই মুক্তিযুদ্ধের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে। তারা ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধিকার চেতনার জাগরণ ঘটায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেকগুলো রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:ন্যাপ(ভাসানী) ন্যাপ(মোজাফফর) কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসস ইত্যাদি। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিছু দল পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রাজাকার আলবদর আল শামস ইত্যাদি। তারা হত্যা লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ সহ নানান ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেখানে ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। গোটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল
স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব ছাত্র জনতা। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়। পাকিস্তানি আমলে প্রতিটি আন্দোলনের মূল আহবায়ক ছিল ছাত্ররাই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তারাই নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। এরপর ১৯৫৪ ১৯৬৬ ১৯৬৯ ১৯৭০ এর প্রতিটি আন্দোলনেই তারা রেখেছিল সক্রিয় ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র জনতা ভ্যানগার্ড নামে অধিক পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে দেশের আনাচে কানাচে থেকে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা একযোগে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। অনেক শিক্ষার্থীরা বাবা-মা কে লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সাথে। তারা চলে যায় সিমান্ত পেরিয়ে পাশের দেশ ভারতে। সেখানে গিয়ে তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ও গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা নাজেহাল করে তোলে।

 

মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে নারীরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অনেক নারীরাই প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি রণাঙ্গনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন নিজের জীবন বাজি রেখে। নারীরা কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে আবার কখনো যুদ্ধেক্ষেত্রের আড়ালে। তারা সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়েছেন প্রেরণা দিয়েছেন অচেনা অজানা অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা সুশ্রুষা করেছেন। নিজেরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করেছেন। অনাহারী অর্ধাহারী ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা কখনো সেবা দিয়েছেন নিজের বোনের মতো কখনো মায়ের মতো। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে নিজেদের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য নারীরা তেমন কোনো বিশেষ স্বীকৃতি পাননি। অনেক নারীযোদ্ধারাই হারিয়ে গেছেন।

 

মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে ও অনুপ্রেরণা জোগাতে এবং জনগণের মনে আধার সঞ্চার করতে ও দেশে বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে দেশ বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয় অসংখ্য নিয়মিত এবং অনিয়মিত পত্রিকা। এসব পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার বীরসেনাদের সাহসীকতার চিত্র এবং পাকবাহিনীর ধ্বংসলীলার দৃশ্য। পত্রিকাগুলোতে এ সম্পর্কে লেখা হতো বিভিন্ন প্রবন্ধ ছড়া রচনা কবিতা গল্প গান কার্টুন ইত্যাদি। সেই সময়ে লেখা সেই পত্রিকাগুলো আজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোতেও বাঙালির বীরত্ব সাহসিকতা পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে অবস্থানকারী বাঙালিরাও বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। মূলত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা সরবরাহকারী বাহিনীর ভূমিকায় কাজ করছেন। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে ছুটে গিয়েছেন। এছাড়াও তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে। পাকিস্তানকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ না করার জন্য বিভিন্ন প্রবাসী সরকারের নিকট আবেদন করেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের ক্ষেত্রেও তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

 

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ছিল জনগণ। তবে দেশের শিল্পী সাহিত্যিকরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়।মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের পত্র পত্রিকায় লেখা বেতার কেন্দ্রের খবর পাঠ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা বিভিন্ন ধরণের দেশাত্মবোধক গান ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান কবিতা নাটক কথিকা ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বজায় রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্র ও জল্লাদের দরবার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অনুপ্রাণিত করেছিল। এককথায় দেশের সকল বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে এবং জনগণকে শত্রুর নিকট দুর্দমনীয় করে তুলেছে।

 

মুক্তিযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের চিত্র বিশ্বের সকল গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ হতে থাকলে সকল রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত তখন প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করতে এগিয়ে আসেন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারতের বাহিনীরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সমর্থন দিলেও মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের বিরোধিতা করে। কিন্তু সেই দেশের সাধারণ জনগণের তোপের মুখে পড়ে মার্কিন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও ভারতের রভি শংকর কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর আয়োজন করে এবং প্রাপ্ত টাকা বাংলাদেশকে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে।

 

মুক্তিযুদ্ধে যৌথ বাহিনী

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ২১ নভেম্বর ভারতের কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমান্ডো। ভারতীয় সেই বাহিনী মিত্রবাহিনী নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীকে অচল করে দেয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী গভীর রাতে বাংলাদেশের সকল রুটে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানের প্রতিটি বিমানঘাটিতে হামলা চালায়। কুর্মিটোলা বিমানঘাটিতে ৫০ টন বোমা ফেলা হয়। তাদের আক্রমণে পাকিস্তানের প্রায় এক ডজনের মতো বিমান বিদ্ধস্ত হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশের সশস্ত্র যোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা নাজেহাল হয়ে পড়ে। তখন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত অধ্যায়। ভারতীয় যোদ্ধাদের সাথে এক হয়ে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীর মনোবল বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক ভারতীয় সেনা মৃত্যুবরণ করেন।

 

মুক্তিযুদ্ধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে যখন মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি করার পদক্ষেপ নেয়। তারা তখন ঝাপিয়ে পড়ে আমাদের দেশের সূর্যসন্তানদের উপর। আর এই কাজে তাদেরকে সাহায্য করেছিল এদেশের এদেশের দোসর রাজাকার আলবদর ও আল শামস বাহিনী। তারা রাতের অন্ধকারে এদেশের মুক্তিকামী ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী সকল শিক্ষক চিকিৎসক ডাক্তার সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাদের অনেকেরই ক্ষতবিক্ষত দেহ ঢাকার রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।

 

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ

মাত্র নয় মাসের যুদ্ধেই পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যৌথবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমনে পাকিস্তানি বাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়ে। তার আর কোনো উপায় না পেয়ে হানাদার পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথ কমান্ডো এর পক্ষে লে জে জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে লে জে নিয়াজী পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।

 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতিকে শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি প্রদান করেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে শত বছরের বাঙালি পরিচয়কে প্রধান্য দিয়ে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই ঐক্য দেশ গঠনে এবং এর উন্নয়নে বাঙালিজাতিকে নতুন উদ্যম প্রদান করে। দেশপ্রেম এবং জাতীয় সঙ্ঘতি একত্রে অত্যাবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই পরে আমাদের সব বিভেদ ভুলে দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসেবে লাল সবুজ পতাকার তলে সমবেত করতে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

 

সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

বাংলাদেশের মানুষের যে স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার মানসে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাধীনতার পর বারবার সরকার বদল হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী তৎপরতা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য যুবসমাজে সৃষ্ট হতাশা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘুষ দুর্নীতি ইত্যাদি কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাজে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ। এ লক্ষ্যে দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাঁথা আর আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। যে আদর্শ উদ্দেশ্য ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তাদের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে ইজ্জত দিয়েছে হাজার হাজার মা বোন আমাদের সমাজ এবং জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ ও চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে এটিই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।

 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও দায়িত্ববোধ

আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে আমাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাই বর্তমানে এই স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টা বাস্তবায়ন করতে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে। দেশের সকল জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যেন তারা দেশের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। দেশের সকল দেশপ্রেমিক শিল্পপতি চাকরিজীবী ব্যবসায়ী বুদ্ধিজীবী ও সকল কর্মকার্তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে সকল বিরোধের ঊর্ধে থেকে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। দেশকে একটি দারিদ্রমুক্ত সুশিক্ষিত ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।

 

উপসংহার

স্বাধীনতা যে মানুষের জন্মগত অধিকার বাংলাদেশের মানুষ তা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম এই স্বাধীনতা। এর মাধ্যমে অবসান ঘটেছিল পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছরের শাসন শোষণ ও নিপীড়নের। তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমরা এখনো বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা গড়তে পারিনি। স্বাধীন জাতি হয়েও স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ এখনো আমরা পাইনি। তাই সকল সংকটকে দূরে ঠেলে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের নিজেরদেরকে দেশপ্রেম কর্তব্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই আমরা রক্ষা করতে পারব আমাদের স্বাধীনতাকে।

 

রচনা: মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু [11 পয়েন্ট]

মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু

ভূমিকা

বিভিন্ন জাতির শ্রেষ্ঠ পুরুষ থাকে। তেমনই বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ পুরুষ হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিপীড়িত জাতির ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের কালােমেঘন তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের গৌরবময় আবির্ভাব। অসাধারণ দেশপ্রেম ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন নাম।

 

ঐতিহাসিক পটভূমির ধারাক্রম

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ বেনিয়াদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যোজন যোজন দূরত্ব সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্থান ও বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত হয় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান। অদ্ভূত দ্বি জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের শাসকদের অনাচার অত্যাচার আর সর্বক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বঞ্চনার স্বীকার হয় বাঙালি জাতি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কেবল অর্থনৈতিক শোষণই নয় বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরও নিপীড়ন শুরু করে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। তখনই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে।১৯৫২ সালে উর্দুকে আবারও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রজনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মিছিলে গুলি চালালে শহিদ হন রফিক জব্বার সালাম বরকতসহ আরও অনেকে। শহিদদের এই পবিত্র রক্তই যেন বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীন লাল সবুজের পতাকার ছবি এঁকে দেয়।১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। মুসলিম লীগের অসহায় ভরাডুবিতে নড়বড়ে হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত। ১৯৫৬ সালে পুনরায় সরকারি ভাষায় বিতর্ক আইয়ুব খানের অপশাসন পাঞ্জাবি ও পশতুনদের ঋণ বাঙালিদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া প্রভৃতি কারণে বাঙালিদের মনের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
১৯৬৬ সালে বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপিত হয়। গণবিক্ষোভ প্রতিহত করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক শাসনের মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর চালাতে থাকে অত্যাচার নিপীড়ন। ১৯৬৮ সালে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানাকে মিথ্যা ও সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি অপশক্তি ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ছেড়ে দেয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। দফায় দফায় বৈঠক করার পরও ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল সমাবেশের ডাক দেন। সমাবেশের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম বলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। এমন একটি উদাত্ত আহ্বানের জন্যই এতদিন যেন অপেক্ষা করেছিল বাঙালি। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এই ডাক। সর্বত্র শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।

 

বাঙালিদের প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা অর্জন

২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সংগঠকবৃন্দ অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের সর্বাত্মক সহায়তা বিশ্ব গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা তদুপরি তিরিশ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

 

স্বাধীনতার ঘোষণা

২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। গ্রেপ্তারের পূর্বে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। পরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়।

 

জন্ম ও পরিচয়

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গােপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান মা সায়েরা খাতুন। দুই ভাই চার বােনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পিতা মাতার তৃতীয় সন্তান। পারিবারিক আনন্দঘন পরিবেশে টুঙ্গিপাড়ায় তার শৈশব কৈশােরের দিনগুলাে কাটে।

 

শিক্ষাজীবন

গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি গােপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪২ সালে এনট্র্যান্স পাশ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ এবং ১৯৪৬ সালে বিএ পাশ করেন তিনি। ১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমেই নেতা মুজিবে বিকশিত হতে থাকেন। ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পর তিনি আইন পড়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

 

রাজনৈতিক জীবন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময়। স্কুলের ছাদ সংস্কারের জন্য একটি দল গঠন করে নিজ নেতৃত্বে তিনি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নিকট দাবি পেশ করেন।১৯৪০ তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে এক বছরের জন্যে যুক্ত হন। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে এনট্র্যান্স পাশ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হন।কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) পড়া থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দান করার সুবাধে তিনি বাঙালি মুসলিম নেতা হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গড়ে তোলার আন্দোলন নিয়ে তিনি ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার পর হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। মুসলিমদের রক্ষা করার জন্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত হন। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারির ৪ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।

 

মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমান ৩রা মার্চ অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন:

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞে সারা বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমনি অবস্থায় গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার ঘােষণা দেন তা ওয়ারলেসের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করলে সারাদেশে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলা রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হয়ে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রচার করে ফলে বিশ্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা সম্পর্কে জানতে পারে।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ

১৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী ঢাকার মাত্র ১৪ কিলােমিটার দূরে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। প্রায় ৯৩০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় বিজয়। এই দিনে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। তাই ‘বিজয় দিবস আমাদের আত্মমর্যাদার ও আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক।

 

ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড

বাংলাদেশের বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হয়। দেশে ফেরার পর ১২ই জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসনভার গ্রহন করেন। এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তােলার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। কিন্তু পরাজিত হায়েনার দল তার সাফল্য ও বাঙালির উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। তাই আবার শুরু হয় ষড়যন্ত্র। দেশ যখন সকল বাধা দূর করে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী ও আন্তর্জাতিক চক্রের শিকারে পরিণত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সামরিক বাহিনীর তৎকালীন কিছু উচ্চাভিলাষী ও বিপথগামী সৈনিকের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। তাই বাঙালি জাতি প্রতিবছর ১৫ ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন করে।

 

উপসংহার

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে যার নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতাে দীপ্যমান তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর দূরদশী বিচক্ষণ এবং সঠিক নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক। জেল জুলুম ও নির্যাতনের কাছে তিনি কখনাে মাথা নত করেননি। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে অস্বীকার করার শামিল। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আজ সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে এক ও অভিন্ন নাম।

 

রচনা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ / বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম (600 শব্দ)

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম/বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

ভূমিকা

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরব আসনে অধিষ্ঠিত। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বিশ্বে মাতৃভূমির জন্য আত্মত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত একটি দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র জনগণের যা দুর্বার সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল বিশ্বে তার কোনো তুলনা নেই। এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবনকে মরণের হাতে সমর্পণ করে যে দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল আর দেশের অগণিত মানুষ জীবনের ভয় তুচ্ছ করে যেভাবে সহযোগিতা প্রদর্শন করেছিলেন তা বিশ্বের সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

ইতিহাসের পটভূমি

১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চে যে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বরে তার অবসান ঘটেছিল পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। কিন্তু এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি আরও অতীতে বিস্তৃত। প্রায় দুশ বছর ইংরেজ শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান অর্জনের মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশ এলাকার মানুষের যে স্বপ্নসাধ ছিল তা অচিরেই পাকিস্তানি শাসকের শোষণ ও অদূরদর্শিতার কারণে নিঃশেষিত হয়ে যায়। বঞ্চনার শুরুতেই প্রতিবাদ উঠেছিল ১৯৪৮ সালে যখন উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রিভাষা বলে ঘোষণা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর প্রাণের দাবি মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদা দানের জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতার আত্মোৎসর্গের ঘটনাটি জাতীয় চেতনাকে নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক এবং ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আইয়ুব খান ক্ষমতা ত্যাগ করে সেনানায়ক ইয়াহিয়া খানের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দিলেও সমস্যার সমাধান হলো না। অনুষ্ঠিত হলো ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হলো না তাকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান “এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম” বলে জাতিকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। আপস আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোপনে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র এনে শক্তি বৃদ্ধি করে এবং ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনারা নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। গভীররাতে তারা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। আহ্বান করেন বাঙালি সন্তান্দের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য।

 

যুদ্ধের ঘটনা

পঁচিশে মার্চের রাতের অন্ধকারে হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে বিপর্যস্ত জাতির স্বাধীনতা ঘোষিত হলো ছাব্বিশে মার্চে। সামরিক বাহিনীর কিছু লোক, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, যুবক, বিভিন্ন পেশার মানুষ সবাই দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য একত্রিত হলো, গঠিত হলো মুক্তিবাহিনী। তারুণ্যের অমিত শক্তি দিয়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে মুক্তিবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল হানাদার বাহিনীর উপর। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী দেশ জুড়ে নির্বিচারে হত্যাকান্ড চালাল, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে লাগল বাড়িঘর। এদেশে নিষ্ঠুর অত্যাচারে এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনী গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে শত্রুদের বিপর্যস্ত করে।

 

শত্রুর আত্মসমর্পণ

‘৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে সংগ্রাম চরম রূপ ধারণ করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ ব্যাপকতর হতে থাকে। আর শত্রু বাহিনীও সর্বাত্মক ধ্বংসলীলা চালাতে থাকে। যুদ্ধের এই চরম পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সাহায্যার্থে ভারতীয় বাহিনী এগিয়ে আসে এবং যৌথ বাহিনীরূপে পাকিস্তানি বাহিনীকে বিপর্যস্ত করতে থাকে। ৩ ডিসেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর আক্রমণে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় হানাদার বাহিনী। ৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকায় রেসকোর্সে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিত্রবাহিনীর কাছে বিনাশর্তে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো। জয় হলো বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের-আকাশে উড়ল সবুক জমিনে লাল সূর্যিখচিত জাতীয় পতাকা। এভাবে বিশ্বের মানিচিত্রে জন্ম হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

 

উপসংহার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল জাতির অস্তিত্বের সংগ্রাম। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে যে শোষণ আর অত্যাচারের শুরু হয়েছিল তার অবসান ঘটে এই যুদ্ধের মাধ্যমে। সমগ্র জাতি, জাতির সর্ব পর্যায়ের মানুষদেশের মুক্তির জন্য আত্মোৎসর্গের চেতনায় নিজেদের উৎসর্গ করেছিল বলেই প্রবল শক্তিধর হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলো। এই সংগ্রাম বাংলাদেশের মানুষকে সীমাহীন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার জন্য দৃঢ় মনোভাব নিয়ে সকলের দায়িত্ব পালন করতে হবে।


রচনা : বিজয় দিবস (১৬ পয়েন্ট)

বিজয় দিবস

সূচনা

১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয় এবং এ দিনটি আমাদের প্রাণের রক্তেও অভিষিক্ত। ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তাই বাঙালির জাতীয় জীবনে বিজয় দিবস পাল রক্তে রাঙানো। এ দিবসে বাঙালি জাতির যুগ যুগান্তরের পরাধীনতার গ্লানি অপনোদনের এবং বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনার শুভগ্ন। ১৬ ডিসেম্বর ঘুরে ঘুরে আমাদের দ্বারে প্রতি বছর উপস্থিত হয়। আমরা পিছন ফিরে অতীত ইতিহাস দেখি।

 

পটভূমি

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পর ঔপনিবেশিক পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর অভিযানের মুখে যারা বাংলাদেশ এক দুঃস্বপ্নের সাগরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। ত্রিশ লক্ষ নর নারী হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল ইজ্জত হারিয়েছিল দুই লক্ষ মা বোন। খালে বিলে নদী নালায় কত মুক্তিসেনার বুকের রক্ত মিশে গেছে লাশের পর লাশ স্তূপীকৃত হয়ে কত বধ্যভূমি রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ২৫ মার্চের ভয়ঙ্কর কালো রাতের অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে দীর্ঘ নয় মাসের শ্বাসরুদ্ধকর দুঃস্বপ্নের পর ১৬ ডিসেম্বর সেই কোটি হৃদয়ের কামনার ধন স্বাধীনতার রক্ত রঙিন পতাকা বিজয়ের গৌরবে উড্ডীন হয়েছে। তাই ১৬ ডিসেম্বর একটা মামুলি জাতীয় দিবস নয়। এর সাথে জড়িত রয়েছে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার গণতান্ত্রিক চেতনা শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও মহত্তের মহিমা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে আমাদের দ্বারে সমাগত হলে আমরা তাই আমূল আলোড়িত হই এবং আত্মস হয়ে আগামী দিনের দেশ গঠনের সংগ্রামে শপথ গ্রহণ করি।

 

আত্মসমীক্ষা

১৯৭১ সাল থেকে ২০১০ সাল। এই দীর্ঘ ঊনচল্লিশ বছরের পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালি জাতির জীবনে কতটুকু তাৎপর্য দান করেছে এটা আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। কোনরূপ বিতর্কে না গিয়ে আমরা বিশ্বজনীন আবেদনে সাড়া দিয়ে শুধু স্বাধীনতার মৌল প্রশ্নে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করি। যে মহান আদর্শ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল দীর্ঘ নয় মাস রক্তঢালা প্রচণ্ড মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল তা আজ স্বাধীনতা লাভের ঊনচল্লিশ বছর পর কতটুকু কার্যকরী ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে তা আমাদের হিসেবে করে দেখতে হবে।

 

জনগণের চেতনা

জনগণ সচেতন না হলে দেশের কোন উন্নয়ন কর্মই ফলপ্রসূ হতে পারে না। আজ গ্রামা থেকে শহর-বন্দর পার হয়ে। রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত একই চেতনা একই লক্ষ্য ও অভিন্ন কর্মসূচি প্রবাহিত না হলে জাতীয় ঐক্য রক্ষা করা সুকঠিন। বাংলাদেশকে মুষ্টিমেয় ধনিক বণিক ও চাটুকার রাজনীতিকদের খাস তালুক বানাবার নীল নকশায় আনা হলে স্বাধীনতার কোন রকম আস্বাদ গ্রহণ সাধারণের পক্ষে সম্ভব হবে না।

 

বাংলাদেশের বিজয় দিবস

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এই দিনে বাঙালি জাতি অর্জন করেছে পূর্ণাঙ্গ বিজয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল। ৩০ লক্ষ শহিদের জীবন উৎসর্গ অগণিত মা বোনের সম্ভ্রমহানি এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৭১ এর এই দিনে পৃথিবীর মনচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। তাই বিজয়ের এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে সর্বাপেক্ষা স্মরণীয়, আনন্দময় এবং গৌরবের দিন।

 

ঐতিহাসিক পটভূমি

প্রায় দুই শত বছর শোষণের পর ১৯৪৭ সালে তীব্র আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশের দখলদারিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত এই দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলমান অধ্যুষিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মূলত দু টি আলাদা ভূ খন্ডে বিভক্ত ছিল। একটি অংশ হলো পশ্চিম পাকিস্তান এবং অন্যটি আমাদের বাংলাদেশ তৎকালীন সময়ে যার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেশ হওয়া সত্ত্বেও শুরু থেকেই গোটা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম অফিস আদালত সবকিছু পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। মোটকথা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কোনো ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা দেয়নি। ফলে সঙ্গত কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তিলাভের ইচ্ছা জাগে। ১৯৫২ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে বাঙালির মনে স্বাধীনতার গোপন ইচ্ছা তীব্রতর রূপ লাভ করে। মূলত ৫২ র এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটেছিল। ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ৬৬ এর ছয় দফা এবং ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত মজবুত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করে বাঙালিরা তাদের আকাক্সক্ষার রূপদানের স্বপ্ন দেখলেও পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের শোষণের কারণে তা অবাস্তবই থেকে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা না দিয়ে বরং দমন পীড়নের পথ বেছে নেয়। এরই প্রতিবাদে বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাঙালির আপামর জনসাধারণের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ডাক দেন। ২৫ মার্চ রাতেই মেজর জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজধানীর ঘুমন্ত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালায়। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা রাজারবাগ পুলিশ লাইন প্রভৃতি স্থানে পাক সেনারা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এরপর ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। কৃষক শ্রমিক ছাত্র শিক্ষক শিল্পী সাহিত্যিক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এদেশের সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অবশেষে ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যার জন্য আপামর জনসাধারণ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করেছিল। ঐদিন রেসকোর্স ময়দানে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এবং সূচনা ঘটে বাংলাদেশের মহান বিজয় জন্ম হয় একটি স্বাধীন দেশের যার নাম বাংলাদেশ।

 

৭১ এর বিজয়োল্লাস

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বাঙালির বহু ত্যাগ তিতীক্ষা ও সাধনার ফল। ৭ কোটি বাঙালির মহা উৎসবের দিন ছিল সেটি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দুঃসহ স্মৃতি স্বজন হারানোর বেদনা সবকিছু ভুলে মনুষ দলে দলে নেমে এসেছিল রাজপথে। সবার হাতে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা।দুর্বিষহ অতীতকে ভুলে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল সম্ভাবনাময় আগামীর বাংলাদেশের। বাঙালির জাতীয় জীবনে এর থেকে আনন্দের দিন আর নেই।

 

বাঙালির বিজয়োৎসব

১৫ ডিসেম্বর রাত ১২.০১ মিনিট থেকে বাঙালির বিজয়োৎসব শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী লাখো শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের জনগণ সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে মিলিত হয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এ দিনে সরকারি ছুটি পালিত হয়। এদিন জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের সকল সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর অংশগ্রহণে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ অসংখ্য মানুষ এ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। বিজয় দিবসের এ দিনে সারাদেশের সমস্ত স্কুল কলেজ ঘর বাড়ি দোকান পাট ও যানবাহনের লাল সবুজ পতাকা দেখা যায়। দিনব্যাপী টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। সারাদেশের সকল মসজিদ মন্দির গীর্জা প্যাগোডায় মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও প্রার্থনা করা হয়। মোটকথা দেশের প্রতি জেলায় প্রতি ঘরে ঘরে বিজয়ের এ দিনটি আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করা হয়।

 

বিজয় দিবসের তাৎপর্য

স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবময় বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বিশ্বের দরবারে স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করেছে। বাঙালির জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের তাৎপর্য অনস্বীকার্য। প্রতি বছর বিজয় দিবস উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্ম মক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এরই ফলশ্রুতিতে তারা স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাস ঐতিহ্য ভাষা সংস্কৃতি প্রভৃতি নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে যা বিশ্বের কাছে জাতি হিসেবে বাঙালির মান মর্যাদা আরো বাড়িয়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির এক চেতনার নাম। আর বিজয় দিবস সেই চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছে কোটি বাঙালির প্রাণে। ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে অন্যায়, অবিচার শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে হয়। প্রতি বছর বিজয় দিবস আমাদের মনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রেরণা দিয়ে যায়। তরুণ প্রজন্মের উচিত লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

 

জাতীয় কর্তব্য

বাঙালি হিসেবে প্রত্যেকেরই এ দিনটির প্রতি কিছু কর্তব্য রয়েছে। কেবল বিজয় দিবসের একটি দিনেই নয় বরং বিজয়ের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রত্যেক বাঙালির উচিত সারা বছরই দেশ জাতি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের পক্ষে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কাজ করে যাওয়া। বিজয় দিবসের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ ও প্রচারে জাতীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয়ের ইতিহাস বিকৃত করে পরবর্তী প্রজন্মকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে সচেষ্ট তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া বাঙালির জাতীয় কর্তব্য।

 

বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট

প্রতিটি স্বাধীন জাতির স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত নানান ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আবেগ। তেমনই আমাদের বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপটে রয়েছে বিপুল ত্যাগ ও সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। সে ইতিহাসের এক গৌরবময় মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। পরে দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী জঙ্গিবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম। এ পটভূমিতেই ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন স্বাধীনতা।পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বীর বাঙালি। শুরু হয় এ দেশে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে মুক্তিসেনাদের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি জীবন বিসর্জন দেয়। অবশেষে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় সূচিত হয়। এই দিনে ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ঘটে ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় ঘটনা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাথা নিচু করে অস্ত্র মাটিতে ফেলে আত্মসমর্পণ করে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে।

 

অনুষ্ঠানমালা

বিজয় দিবস উদযাপিত হয় মহাসমারােহে। এ দিন সারাদেশ ছেয়ে যায় লাল সবুজের সাজে। বাড়ির ছাদে দোকানে রাস্তার পাশে গাড়ির সামনে স্কুল কলেজে এমনকি রিকশার হ্যান্ডেলেও শােভা পায় লাল সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা। প্রতিটি শহরে পরিলক্ষিত হয় উৎসবের আমেজ। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী আয়ােজন করে গণমুখী নানা অনুষ্ঠানের। স্বাধীনতার আবেগে উদ্বেলিত নরনারী উৎসবের সাজে সেজে সেখানে জমায়েত হন। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নানারকম অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে।এইদিন সকালবেলা ঢাকার জাতীয় প্যারেডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কূটনীতিবিদ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষ এই কুচকাওয়াজ উপভােগ করেন। চট্টগ্রাম এবং তার আশেপাশের এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার মানুষ এই মেলা দেখতে আসেন। দেশের প্রতিটি জেলায়ও উৎসবমুখর পরিবেশে এই দিনটি পালিত হয়।

 

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় পরবর্তী বাস্তবতা ও আমাদের প্রত্যাশা

শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলেও আমাদের স্বপ্ন সম্ভাবনা বাস্তবের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে। ১৯৭৫ এ ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে জাতির জনকের মর্মান্তিক মুত্যুর মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ হয় পরিত্যক্ত। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র হয় নির্বাসিত। প্রায় দেড় দশক জুড়ে নতুন করে সংগ্রাম করতে হয়েছে গণতন্ত্রের জন্যে। আদর্শিকভাবে স্বাধীনতার মূল চেতনার অনেক কিছুই এখন অধরা। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে এখনও পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন এখনও স্বপ্ন মাত্র। জাতীয় জীবনে ঐক্যের বদলে সংঘাত সুস্থিতির বদলে অস্থিরতা শান্তির বদলে নৈরাজ্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

 

বিজয় দিবস উদ্যাপন

প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর চরম উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সারা দেশে পালিত হয় মহান বিজয় দিবস। এদিন সারা দেশে সরকারি ভবনসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। সারা দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। পত্রপত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। টিভি ও রেডিও চ্যানেলগুলো প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এভাবে সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে বিজয় দিবস হয়ে ওঠে উৎসবের দিন।

 

বিজয় দিবসের চেতনা

বিজয় দিবস আমাদের দেশপ্রেমকে শাণিত করে। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে লড়াই করার প্রেরণা পাই। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিজেদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হই। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে শিখি এই দিনে।

 

উপসংহার

সরকারি বেসরকারি রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সকল মহলের কাছে আমাদের আরজ বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা সংকটে বিভেদবিসম্বাদ ভুলে স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণকে সচেতন ও শ্রমশীল করার জন্য এবং স্বাধীনতার আদর্শ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পুরাপুরি অর্জনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পথের জঞ্জাল সরিয়ে দেশ গঠনে ও সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যৎ রচনার সংগ্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শান্তি ও সুখ সমৃদ্ধির জন্য একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের মহতী চেতনা আবার জাগরিত করে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।


আরো দেখুন (প্রবন্ধ রচনা) :