শতভাগ বিদ্যুৎঃ আলোকিত বাংলাদেশ
ভূমিকা
সভ্যতার উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক বিদ্যুৎ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই বিদ্যুতে এখন স্বয়ংসম্পুর্ণ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে সরকার ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ’ বাস্তবায়ন করেছে। ফলে আজ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত পুরো দেশ।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ইতিহাস
ব্রিটিশ শাসিত ভারতের তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী হিসেবে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই তিনি সর্বপ্রথম বিলাত থেকে আমদানি করা জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে রাজবাড়ি আলোকিত করেন। এরপর ১৯০১ মি. বোল্টন নামে জনৈক ব্রিটিশ নাগরিক আহসান মঞ্জিলে সুইচ টিপে প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহের সূচনা করেন। নবাব আহসানউল্লাহর অর্থানুকূল্যে অক্টাভিয়াস স্টিল নামক কোম্পানি তৎকালীন ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক ও আহসান মঞ্জিলসহ পর্যায়ক্রমে ঢাকার কয়েকটি অভিজাত ভবনকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার আওতায় এনেছিল। ১৯১৯ সালে ‘ডেভকো’ নামক ব্রিটিশ কোম্পানির মাধ্যমে ঢাকায় সীমিত আকারে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার প্রথম বাণিজ্যিক বিকাশ শুরু হয়। ১৯৩৩ সালে একই কোম্পানি ঢাকার পরীবাগে প্রায় ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ধানমন্ডি পাওয়ার হাউজ’ নির্মাণ করে বানিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ বিতরণ শুরু করে। দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় ইলেক্ট্রিসিটি ডাইরেক্টরেট। ১৯৫৭ সালে সরকার দেশের সকল বেসরকারি পাওয়ার হাউজ ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাওন অধিগ্রহণ করে। ১৯৫৯ সালে Water & Power Development Authority (WAPDA) গঠনের পর বিদ্যুৎখাতে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। ১৯৬০ সালে ইলেক্ট্রিসিটি ডাইরেক্টরেট WAPDA’র সাথে একীভূত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ৩১ মে ১৯৭২ রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে (পিও ৫৯) সাবেক WAPDA থেকে পৃথক হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সমন্বিত সংস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নতন বোর্ড (BPDB)।
উৎপাদন
জাতীয় প্রবৃদ্ধির অর্জন, দারিদ্র বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিদ্যুৎ একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। সবার জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার বিদ্যুৎখাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, ডুয়েল-ফুয়েল, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও নিউক্লিয়ার এনার্জিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎখাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ২৫, ২৩৫ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে গ্রিডভিত্তিক উৎপাদন ক্ষমতা ২২,০৩১ মেগাওয়াট, ক্যাপটিভ ২,৮০০ মেগাওয়াট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি (অফগ্রিড) ৪০৪ মেগাওয়াট। গ্রিডভিত্তিক উৎপাদনের মধ্যে সরকারি খাতে ১০,১৪৬ মেগাওয়াট, বেসরকারি খাতে ৯,৪৮১ মেগাওয়াট, যৌথ উদ্যোগে ১,২৪৪ মেগাওয়াট এবং বিদ্যুৎ আমদানি ১,১৬০ মেগাওয়াট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বর্তমানে দেশে গ্যাস টারবাইন, রেসিপ্রোকেটিং ইঞ্জিন, স্টিম টারবাইন, কম্বাইন্ড সাইকেল পানিভিত্তিক ও সোলার ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে।
আমদানি
দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে প্রতিবেশী দেশ থেকে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। ৫অক্টোবর ২০১৩ শুরু হয় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি। বর্তমানে প্রতিদিন ভারতের বহরমপুর হতে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে ১,০০০ মেগাওয়াট এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পালটানা থেকে কুমিল্লা হয়ে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। সেই সাথে নেপাল ও ভুটানের সাথে যৌথ মালিকানায় হাইড্রো পাওয়ার প্রকল্প স্থাপন এবং বিদ্যুৎ আমদানি করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
সঞ্চালন
দেশের বিদ্যুৎখাতে দক্ষতা, জবাবদিহিতা ও গতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিদ্যুৎখাত সংস্কারের আওতায় কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ এর অধীনে ২১ নভেম্বর ১৯৯৬ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিঃ (PGCB) প্রতিষ্ঠিত হয়। PGCB নিরবিচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটওয়ার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং উক্ত সঞ্চালন সিস্টেম পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণসহ আন্তঃদেশীয় সঞ্চালন গ্রিড লাইন নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। PGCB সারাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ৪০০ কেভি, ২৩০ কেভি এবং ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন ও উপকেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিতরণ প্রান্তে পৌঁছে দিয়ে থাকে।