জীর্ণ পুরাতন বছরের দুঃখ, ক্লেশ, যাতনাকে দূরে সরিয়ে জীবনের হিসাবে নতুন খাতা শুভ হালখাতা নিয়ে প্রতি বছর ঘুরে আসে বাঙালির চির ঐতিহ্যের আর উৎসবময় সংস্কৃতির সর্বজনীন রূপের ধারক ‘শুভ নববর্ষ’। বৈশাখী নববর্ষ নবসৃষ্টির অগ্রদূত, সুন্দর স্বপ্ন বুননের অগ্রপথিক ও নতুনের বিজয়কেতন।
বাংলা সন গণনার জন্ম ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস
জানা যায়, এ গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় সভ্যতা, সংস্কৃতি, লোকাচার, উৎসব, পার্বণ সবই কৃষিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলা সনের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। তখন অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে বাঙালিরা নববর্ষের উৎসবে মেতে উঠত। রাজকার্য সম্পাদনে হিজরি সাল নিয়ে কিঞ্চিৎ অসুবিধার সৃষ্টি হলে সম্রাট আকবর বঙ্গদেশ বা সুবে বাঙ্গালার জন্য পৃথকভাবে বাংলা সন সৃষ্টির নির্দেশ দেন। সম্রাট রাজসভার নবরত্নের বাইরে দশম রত্ন আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে বাংলা সন আবিষ্কারের দায়িত্ব দেন। প্রচলিত হিজ্রি চান্দ্র সন এবং বাংলা সৌর সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সম্রাটের রাজজ্যোতিষী পণ্ডিত আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি বাংলা সনের উদ্ভাবন করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এ গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় সম্রাটের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এ সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে। বস্তত খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে সম্রাট বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষ্যে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
সৌর পঞ্জিকা অনুসারে নববর্ষ
এই সৌর পঞ্জিকার শুরু গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ; কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক : বাংলা নববর্ষ
বাংলা নববর্ষ (পহেলা বৈশাখ) বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান এবং অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব। সম্প্রীতির মিলিত স্রোত বাংলা সনটিকে অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। বস্তত শিশু-যুবা-বৃদ্ধাসহ সব বয়সের, সব শ্রেণি ও ধর্মের মানুষই এ দিনটি উদযাপন করে। আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। পহেলা বৈশাখ মানে জীর্ণ-শীর্ণ পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনের আহ্বানে সামনে এগিয়ে যাওয়া, বাঙালির চিরায়ত উৎসবে মেতে ওঠা, প্রাণ খুলে আনন্দে ভেসে যাওয়া। আর তাই অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির কামনায় উদযাপিত হয় প্রাণের স্পন্দন বাংলা নববর্ষ ‘পহেলা বৈশাখ’। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান-
হালখাতা
নতুন বাংলা বছরের হিসাব পাকাপাকিভাবে টুকে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ হালখাতা। এতে তাদের কাজ কারবারের লেনদেন, বাকি-বকেয়া, উসুল আদায় সবকিছুর হিসাব-নিকাশ লিখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রাম বাংলার প্রতি বাজারে এই রীতি লক্ষ্য করা যায়, যার মূল ক্রেতা হলেন গ্রামীণ কৃষক।
পুণ্যাহ
সাধারণত জমিদারি আমলেই অনুষ্ঠিত হতো পুণ্যাহ অনুষ্ঠান। এটি ছিল খাজনা আদায়ের একটি আনুষ্ঠানিক প্রীতিপূর্ণ কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান। এখনও এই অনুষ্ঠান চলমান।
বৈশাখী মেলা
সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন উৎসব বৈশাখী মেলা। এ মেলা সাধারণত একদিন থেকে তিনদিন অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাতদিনও স্থায়ী হয়। এ দেশে জমিদারি আমলে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যেই সম্ভবত বৈশাখী মেলার পত্তন ঘটে। বস্তুত বৈশাখী মেলা বাঙালির সর্বজনীন উৎসবের একাংশ। এটি বর্তমানে একটি সাংস্কৃতিক লোক-উৎসবে পরিণত হয়েছে সারা দেশে।
এটি কোনো ধর্মীয় ঐতিহ্য, কিংবদন্তি কিংবা বিভিন্ন পালা পার্বণনির্ভর অনুষ্ঠান নয়। সে কারণেই এটি সমস্ত বাংলা ও বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। বাঙালি লোকায়ত সংস্কৃতির বিভিন্ন পলিমাটির সমন্বয়েই এটি গড়ে উঠেছে। বৈশাখী মেলা শহরের চেয়ে গ্রাম গঞ্জেই অধিক বসে৷ তাই বৈশাখী মেলা যেন গ্রামীণ জীবনের জাগরণের প্রতীক হয়ে ওঠে। বস্তুত গ্রাম গ্রাম বাংলার লোকজীবনের সঙ্গে বৈশাখী মেলার আবেদন অত্যন্ত নিবিড় ও গভীর।
ছায়ানটে বর্ষবরণ
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা চর্চা, ধারণ ও লালনে ছায়ানটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বর্ষবরণে ছায়ানট বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে এ দিনটিকে উৎসবমুখর করে তোলে। ছায়ানট বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬১ সালে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ রমনার বটমূলে ছায়ানটের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
বাঙালির বর্ষবরণ আয়োজনে মিশে আছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এ শোভাযাত্রায় চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। এ শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। আরও থাকে বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, রং বেরংয়ের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রানীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সালে প্রথম শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া ও হাতি।
বৈসাবি
এ উৎসব প্রতিবছর ইংরেজি এপ্রিল মাসের ১২,১৩ ও ১৪ তারিখ এবং বাংলা চৈত্র মাসের ৩০ ও ৩১ তারিখ এবং নতুন বছরের বৈশাখের ১ তারিখ পালন করা হয়। বাংলা বছরের শেষ দুইদিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহ বিভিন্ন নামে এ উৎসব পালন করলেও সমতলে এটি বৈসাবি নামে পরিচিত। চাকমারা এ উৎসবকে বিজু, ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই, এবং তঞ্চৈঙ্গারা বিষু নামে আখ্যায়িত করে।
প্রাণের নববর্ষ হোক চেতনার ধারক
নববর্ষ আমাদের জীবনে কেবল একটি উৎসব নয় বরং একদিকে যেমন নির্মল আনন্দের খোরাক, অন্যদিকে তেমনি একটি চেতনার ধারক। এ দিনটি আমাদের দরিদ্র, নিপীড়িত ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগায়। তাই বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে হতে হবে শেকড়সন্ধানী। আকড়িয়ে ধরতে হবে বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতিকে। পরিহার করতে হবে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি। তাহলেই সার্থক হবে বাঙালির ‘নববর্ষ’ উদযাপন। নতুনের আহ্বানে কবিকণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা বলি-
যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।