উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশাত্নবোধক ও স্বাজাত্যবোধের ঋত্বিক। বাংলা ভাষায় শিল্পসম্মত উপন্যাস রচনার প্রথম কৃতিত্ব তাঁর। নিষ্ঠাবান হিন্দু। গীতার অনুশীলন তত্ত্বের (জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম ও কর্ম) ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ অভিপ্রায়ে লেখনী ধারণ করেন।
জন্ম : পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পগনার কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ২৬ জুন ১৮৩৮ (১৩ আষাঢ় ১২৪৫)।
মাতা : দুর্গাসুন্দরী দেবী।
পিতা : যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ডেপুটি কালেক্টর)।
বিবাহিত জীবন : তিনি ১১ বছর বয়সে পঞ্চম বর্ষীয়া বালিকা মোহিনীদেবীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৮৪৯ সালে। মহিনীদেবীর মৃত্যুর (১৮৫৯) পর রাজলক্ষ্মী দেবীর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন ১৮৬০ সালে।
শিক্ষা ও কর্মজীবন : ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রথম স্নাতকদের মধ্যে তিনি একজন। পেশাগত জীবনে তিনি ১৮৫৮ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেন।
সাহিত্যচর্চায় আত্ননিয়োগ : ১৮৫২ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য চর্চার শুরু।
‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ ও সম্পাদনা : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় মাসিক ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৮৭২ সালে। এই পত্রিকার মাধ্যমে বাংলা গদ্যের প্রভূত উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
সাহিত্যকর্ম
উপন্যাস : Rajmohon’s wife, দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল, রজনী, চন্দ্রশেখর, রাজসিংহ, ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়, রাধারাণী।
ত্রয়ী উপন্যাস : আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী, সীতারাম।
কাব্য : ললিতা তথা মানস।
প্রবন্ধ : লোকরহস্য, বিজ্ঞানরহস্য, কমলাকান্তের দপ্তর, সাম্য, কৃষ্ণচরিত্র, ধর্মতত্ত্ব অনুশীলন, শ্রীমদ্ভগবদগীতা।
জীবনাবসান : কলকাতা, ৮ এপ্রিল ১৮৯৪ (২৬ চৈত্র ১৩০০)।
কৃষ্ণকান্তের উইল
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসে পারিবারিক জীবনের সংঘাত ও সমস্যা রূপায়ণের আলোকে সামাজিক সমস্যা উন্মোচন করেছেন। এ উপন্যাসে রোহিণী, গোবিন্দলাল ও ভ্রমরের ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। স্ত্রীর বর্তমানে বিধবা নারীর প্রতি পুরুষের প্রেমাসক্তির কুফল এ উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য।
এ উপন্যাসের সবচেয়ে আলোচিত তথা বাংলা সাহিত্যের এক অমর চরিত্র ‘রোহিনী’। বাল্যবিধবা রোহিনী রূপবতী, বুদ্ধিমতী ও চঞ্চলা। অন্যদের থেকে রূপে গুণে বেশি হয়েও সে বিধবা হওয়ায় সংসার সুখ থেকে বঞ্চিত। প্রথমেই সে সম্পত্তির উইল চুরি করে কৃষ্ণকান্তের সাথে প্রতারণা করে হরলালকে বিয়ে করার জন্য কিন্তু হরলাল রোহিনীর সাথে প্রতারণা করে। সে বলে যে- ‘আমি যাই হই- কৃষ্ণকান্ত রায়ের পুত্র, যে চুরি করিয়াছে, তাহাকে কখনো গৃহিনী করিতে পারিব না।’ হরলালের এমন আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করে রোহিণী বলিল, ‘আমি চোর! তুমি সাধু! কে আমাকে চুরি করিতে বলিয়াচিল? কে আমাকে বড় লোভ দেখাইল? সরলা স্ত্রীলোক দেখিয়া কে প্রবঞ্চনা করিল?’ পুরুষের প্রতি নারীর এমন প্রতিবাদ তখনকার সমাজে অনভিপ্রেত ছিল। তারপর রোহিনী প্রেমে পড়ে কৃষ্ণকান্ত রায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র, ভ্রমরের স্বামী গোবিন্দলালের। করুণাবশত রোহিনীকে চুরির অপরাধে কৃষ্ণকান্তের শাস্তি থেকে বাঁচাতে চায় গোবিন্দলাল। আর তখনই রোহিনী গোবিন্দলালকে ভালো লাগার কথা বলে ফেলে। কিন্তু গোবিন্দলাল সাড়া দেয় না। গোবিন্দলালকে না পাওয়ার বেদনা ও ব্যর্থ যৌবনের হাহাকারে সে বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে বালবিধবা রোহিনীর অসাধারণ রূপ ও সব কাজের দক্ষতা স্ত্রীর ভালবাসায় পরিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও গোবিন্দলালকে আকর্ষণ করে। গোবিন্দলাল রোহিনীর প্রেমে সাড়া দেয়।
ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র রোহিণী চরিত্রের মাধ্যমে মানুষের জৈবিক বাসনা-কামনার বিষয়টিকে সামাজিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে চাইলেও ভ্রমরের মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রথাগত সমাজব্যবস্থার প্রতিও সমর্থন করেছেন। গোবিন্দলালের স্ত্রী ভ্রমর। সারা উপন্যাসব্যাপী তার বিস্তার। স্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত সহজ সরল। যার কাছে স্বামীই সব। তার মতে স্বামীকে অবিশ্বাস করতে নেই, সব ক্ষেত্রেই স্বামীকে অনুসরণ করা স্ত্রীলোকের ধর্ম।
সমাজের সর্বত্র যখন রোহিণী ও গোবিন্দলালকে ঘিরে নানা কুৎসা ও অপবাদ বিস্তার লাভ করছে, তখনও ভ্রমরের স্বামীর প্রতি সন্দেহ পোষণে দ্বিধাবোধ ব্যক্ত হয়েছে। মনে মনে বলিল “হে সন্দেহভঞ্জন! হে প্রাণাধিক! তুমিই আমার সন্দেহ, তুমি আমার বিশ্বাস! আজ কাহাকে জিজ্ঞাসা করিব? আমার কি সন্দেহ হয়? কিন্তু সকলেই বলিতেছি। সত্য না হইলে, সকলে বলিবে কেন! তুমি এখানে নাই, আজি আমার সন্দেহভঞ্জন কে করিবে?” ভ্রমর কোনো দিন বিশ্বাস করতে পারেনি গোবিন্দলাল রোহিণীকে ভালবাসতে পারে। এটা তার চিন্তারও বাইরে। কিন্তু গোবিন্দলাল রোহিনীর প্রেমে পড়ে এই ভ্রমরের সাথে প্রতারণা করে। একপর্যায়ে স্ত্রীকে রেখে রোহিনীকে নিয়ে গোবিন্দলাল পালিয়ে যায় এবং তারা যশোরে একসাথে বসবাস করতে থাকে। তবে গোবিন্দলাল রোহিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয় না, কিন্তু তার কাছ থেকে শর্তহীন পতিব্রত্য দাবি করে। আবার রোহিনীর সাথে বসবাসের সময় একপর্যায়ে সে ভ্রমরকে ফিরে পেতে চায়। যেভাবে ভ্রমরের সাথে বসবাস করার সময় সে রোহিনীকে কামনা করেছিল। মোটকথা গোবিন্দলাল যা চেয়েছে তার মূল্য দিতে কখনোই প্রস্তুত থাকেনি।
অন্যদিকে, ভ্রমরের পিতা নিজের কন্যার সংসার ও জীবন বাঁচানোর জন্য রোহিনী ও গোবিন্দলালকে আলাদা করার কৌশল অবলম্বন করে। সে চক্রান্ত করে নিশাকরের মাধ্যমে একটি ফাঁদ পাতে। রোহিনী নিজের রূপের আকর্ষণ যাচাইয়ের মোহে সে ফাঁদে পা দেয়। নিশাকরের সাথে চুপিসারে দেখা করতে এসে গোবিন্দলালের নিকট হাতেনাতে ধরা পরে। গোবিন্দলালের পিস্তলের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। তখন গোবিন্দলাল ভ্রমরকে ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে কিন্তু ততদিনে অপেক্ষায় জর্জরিত ও অসুস্থ ভ্রমরের জীবনাবসান ঘটে।
এ পর্যায়ে গোবিন্দলাল সন্ন্যাস গ্রহণ করে। এ উপন্যাসের কাহিনিতে এটুকু ফুটে উঠে যে এরকম পরিস্থিতিতে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা থাকে না। প্রেমের উপাখ্যান সবসময় মিলনে শেষ হয় না, ট্রাজেডিতেও শেষ হয়।
রোহিনী এ উপন্যাস তথা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম চরিত্র। এ উপন্যাসে লেখক রোহিণীকে কুটিল ও অদম্য সাহসী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তার কুটিলতা প্রথম ধরা পড়ে যখন সে ভ্রমরের ভুল না ভাঙিয়ে বেদনা আরো বাড়িয়ে দেয়। গোবিন্দলাল রোহিণীকে বহুমূল্য উপহারসামগ্রী প্রদান করেছে- এ মিথ্যা লোক্মুখে রটে গেলে রোহিণী ভ্রমরের কাছে গিয়ে সত্য কথা না বলে উল্টো বলে- ‘লোকে যতটা বলে ততটা নহে। লোকে বলে, আমি সাত হাজার টাকার গহনা পাইয়াছি। মোটে তিন হাজার টাকার গহনা আর এই শাড়িখানা পাইয়াছি। তাই তোমায় দেখাইতে আসিয়াছি। সাত হাজার টাকা লোকে বলে কেন?” এই বলে ধার করা শাড়িটা দেখায়। অদম্য সহসের ফলে সে বারবার ভুল করে। শেষ ভুলটা করে নিশাকরের প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে।
বঙ্কিমচন্দ্র এ উপন্যাসজুড়ে দেখিয়েছেন খারাপ প্রবৃত্তিগুলোর পরিণাম খারাপই হয়। একই সাথে খারাপের উপর ভালোর অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। এজন্য তিনি মানুষের মনোগত দুটি সত্তাকে কুমতি ও সুমতি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। রোহিণী হরলালকে পেতে কৃষ্ণকান্তের উইল চুরি করে হরলাল কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে অনুশোচনা করে। তখন ঔপন্যাসিক রোহিণীর অবস্থা বর্ণনা করতে সুমতি ও কুমতি কথোপকথন যোগ করেন। সুমতি বলিতেছিল, “এমন লোকেরও সৰ্ব্বনাশ করিতে আছে?’’! কুমতি-উইল তো হরলালকে দিই নাই । সৰ্ব্বনাশ কই করিয়াছি ? সু- কৃষ্ণকান্তের উইল কৃষ্ণকান্তকে ফিরাইয়া দাও। কু- বাঃ, যখন কৃষ্ণকান্ত আমাকে জিজ্ঞাসা করিবে, “এ উইল তুমি কোথায় পাইলে, আর আমার দেরাজে আর একখানা জাল উইলই বা কোথা হইতে আসিল,” তখন আমি কি বলিব? খারাপ প্রবৃত্তির কারণেই ভ্রমরকে রেখে গোবিন্দলাল রোহিণীর দিকে ধাবিত হয়। গোবিন্দলালের ভ্রমরের প্রতি বিরাগ সৃষ্টির বিষয়টিতেও সুমতি ও কুমতির প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল। ‘কুমতি বলিল, “ভ্রমরের প্রথম অপরাধ, এই অবিশ্বাস |” সুমতি উত্তর করিল, “যে অবিশ্বাসের যোগ্য, তাহাকে অবিশ্বাস না করিবে কেন? তুমি রোহিণীর সঙ্গে এই আনন্দ উপভোগ করিতেছ, ভ্রমর সেটা সন্দেহ করিয়াছিল বলিয়াই তার এত দোষ?” মানুষ যখন রিপুর তাড়নায় রিরংসায় জর্জরিত হয় তখন বিবেকবোধ অচল হয়ে বিপথগামী হয়। এর পরিণাম তিনি দেখিয়েছেন গোবিন্দলালের ক্রমাগত অধঃপতন। একই পরিণতি হয় রোহিণীরও।
এ উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণে, ঘটনা বিন্যাসে ও চরিত্র চিত্রণে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে রোহিনী চরিত্র চিত্রণে। উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক পাঠককে পরনারীতে আসক্তির কুফলের শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। এছাড়া রোহিনী চরিত্রের বেদনা-বঞ্চনা ও বিনাশই পাঠককে ভাবিয়ে তোলে। রোহিনী চরিত্র শুধু এ উপন্যাসেই নয় সমগ্র বাংলা সাহিত্য একটি ঈর্ষণীয় চরিত্র। বঙ্কিম নিজেও এ উপন্যাসে রোহিনীকে কেন্দ্র করে নৈতিক আদর্শ ও শিল্পবোধের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান। আর তাঁর এ ধরণের মনোভাবের কারণেই প্রতীয়মান হয় যে নীতিবাদী বঙ্কিমের কাছে শিল্পী বঙ্কিমের পরাজয় ঘটেছে।