বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
ভূমিকা
বাংলাদেশকে প্রকৃতির লীলানিকেতন বলা হয়। লীলাময়ী প্রকৃতি মুক্তহস্তে আপন সৌন্দর্য দান করে এ দেশকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করেছে। নদী নালায় শস্যসম্পদে ঋতু বৈচিত্র্যে সবুজের সমারোহে পরিপূর্ণ এমন সুন্দর দেশ পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ।
গ্রামবাংলার দৃশ্য
বাংলাদেশ মূলত গ্রামবহুল দেশ। আটষট্টি হাজার গ্রাম নিয়ে এ দেশ গঠিত। গ্রামের শস্যশ্যামল ক্ষেত তৃণাচ্ছাদিত উন্মুক্ত প্রান্তর পুষ্পপল্লবে ঘেরা ঝোপঝাড় বৃক্ষরাজির সুনিবিড় ছায়া নানা প্রকার পাখীর কলতান আম জাম কাঁঠালের কুঞ্জবন প্রভাতের স্নিগ্ধ সূর্যকিরণ গোধূলির স্তব্ধ গাম্ভীর্য সত্যই আমাদেরকে মুগ্ধ না করে পারে না। মোটকথা গ্রামবাংলার এমন শান্ত স্নিগ্ধকমনীয় রূপ পুষ্পমঞ্জরীতে পরিপূর্ণ এমন মানুষমণ্ডিত সুন্দর পরিবেশ সত্যই দুর্লভ।
পল্লির প্রাকৃতিক দৃশ্য
হাজারো গ্রামের সমন্বয়ে গড়ে উঠা বাংলার পল্লি প্রকৃতি রাণীর বাসর ঘর সদৃশ। জ্যোৎস্না গ্লাবিত রাতে প্রকৃতি যেন সবুজ পাড় সম্বলিত তারকার বুটি দেওয়া নীলাম্বরী শাড়ি পরে এবং পুষ্পমাল্য শোভিত কণ্ঠে মনোলোভা রূপ সমেত পল্লির বাসর ঘরে প্রিয়জনের আগমন প্রতীক্ষায় চাঁদের প্রদীপ হাতে পথপানে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। পল্লির অগণিত মাঠ ঘাট ত্রিকালের সাক্ষী বটবৃক্ষের ছায়া তৃণগুলা শোভিত অরণ্যানীর মাধুরী শস্যক্ষেতের শ্যামলিমা ইত্যাদির অনির্বচনীয় সৌন্দর্য এবং সুদূর হতে ভেসে আসা রাখালের বাঁশির সুর দেশি বিদেশি সবারই হৃদয় মন হরণ করে।
নদ নদীর দৃশ্য
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদ নদী খাল বিল এখানে জালের মত ছড়িয়ে আছে। পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্রহ্মপুত্র ইত্যাদি স্রোতস্বিনী এর বুকে সদা চঞ্চলা বালিকার মত লীলায়িত ভঙ্গিতে ছুটে চলেছে। এসব নদীতীরের দৃশ্য অতীব মনোরম। এদের বুকে অসংখ্য নৌকা পাল তুলে লঞ্চ ষ্টীমার ইত্যাদি বাষ্পীয় যান ধূম উদ্গীরণ করে যখন দ্রুতগতিতে ধাবিত হয় তখন নদীর জলধারা তরঙ্গায়িত হয়ে এক অপরূপ শোভার সৃষ্টি করে। নদীবক্ষে পতিত জ্যোৎস্নার রূপালী আলোর মেলা আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয়।
ঋতু বৈচিত্র্য
বাংলার ষড়ঋতু লক্ষ্য করার মত। গ্রীষ্মের খররৌদ্রে এর শান্ত ও সৌম্য রূপ দুর্দান্ত আবেগে ফেটে পড়ে। কাল বৈশাখীর প্রচণ্ড তান্ডবে আমাদের সবকিছু তছনছ হয়ে যায় । আঁধারের যেমন একটি রূপ আছে এ রুদ্র প্রকৃতিরও তেমনি একটি বিশেষ রূপ আছে। প্রকৃতির শক্তির কাছে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। বর্ষার বারিধারার সাথে সাথে প্রকৃতির এ অশান্ত রূপ পরিবর্তিত হয়ে সৌম্য ও শান্ত রূপ ধারণ করে। আকাশ তখন ঘন মেঘে ঢেকে যায়, গুরুগম্ভীর মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চোখঝলসানো আলোর মাঝে নেমে আসে বর্ষার অবিরল ধারা, নদনদী কানায় কানায় পূর্ব হয়। মাঠঘাট প্লাবিত হয়। বনলতা, বৃক্ষরাজি আবার নতুন পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়। আসে শরৎ তার শিশির ও শেফালি ফুলের ডালি নিয়ে। শুভ্র হাল্কা মেঘ তখন আকাশে ইতস্ততঃ ভেসে বেড়ায়। জলে কুমুদদল মনের আনন্দে খেলা করতে থাকে। আসে হেমন্ত । তখন আকাশ বাতাস শুভ্র রূপ ধারণ করে। কৃষকের ক্ষেত থামার শস্যে পরিপূর্ণ হয়। হেমন্তের পরে আসে শীত। শীতে প্রকৃতি মলিন ও আড়ষ্ট ভাব ধারণ করে। সর্বশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। ফুলের মনমাতানো সৌরভে চারদিক মোহিত হয়। কোকিলের কুহু রবে কুঞ্জবন মুখরিত হয়। মৃদু মন্দ সমীরণ আমাদের হৃদয় মনকে সাব ও সতেজ করে তোলে। এভাবে বার মাস ধরে এদেশে ষড়ঋতুর বিচিত্র লীলা চলতে থাকে।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অবস্থান
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। বাংলাদেশের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। এজন্য বাংলাদেশের জলবায়ু মােটামুটি সমভাবাপন্ন। মৌসুমি বায়ুর প্রভাব দেশের জলবায়ুর ওপর এত বেশি যে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঋতুতে জলবায়ুর কিছুটা তারতম্য লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪° সেলসিয়াস এবং শীতকালীন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ০৭° সেলসিয়াস। এ দেশের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় ২০৩ সেন্টিমিটার। পশ্চিমাংশ অপেক্ষা পূর্বাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশের মােট বৃষ্টিপাতের পাঁচ ভাগের চার ভাগই বর্ষাকালে হয়ে থাকে। শীতকালে উত্তর-পূর্ব শুষ্ক মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশের উত্তরে ভাওয়াল ও মধুপুর গড়। গেরুয়া রঙের মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গজারি গাছ। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর সুন্দরবন। পূর্বে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সাজানাে চা বাগান। এরই মাঝে বিশাল সব ছায়াবৃক্ষ। পশ্চিমে ধু ধু প্রান্তর। প্রকৃতির রুক্ষতার মাঝেও এখানে দেখা যায় সারি সারি আম্রকানন আখের খেত কিংবা পানের বরজ। বাংলাদেশের সুন্দরবন সুন্দরী গাছের জন্য বিখ্যাত। কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৈকত। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকাজুড়ে সীমাহীন সৌন্দর্যের সমাবেশ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আদিবাসীদের বসবাস। হাতে গােনা শহরগুলাে বাদ দিলে বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। গ্রামের সৌন্দর্যে কোনাে কৃত্রিমতা নেই। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। প্রকৃতিগত অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশকে সমৃদ্ধিশালী দেশ বলা যায়।
বাংলাদেশের মাটি
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছােট বড় অসংখ্য নদী এদেশে জালের মতাে ছড়িয়ে আছে। প্রতিবছর বন্যায় এ নদীগুলাে পলিমাটি বহন করে। আর এ কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল পলিমাটি দিয়ে গঠিত। পলি মাটির উর্বরতার কারণে এদেশে ভালাে ফসল জন্মায়। এদেশের প্রায় অধিকাংশ অঞ্চলে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন করা হয়।
বাংলাদেশের তাপমাত্রা
বাংলাদেশ নাতিশীতােষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত। এদেশের ওপর দিয়ে ক্রান্তীয় মৌসুমি বায়ু বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় প্রবাহিত হয়। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪৫° সেলসিয়াস এবং শীতকালে ১৫ থেকে ২৫° সেলসিয়াস থাকে। এদেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বেশি শীত ও এপ্রিল মে মাসে গরম বেশি থাকে। তবে প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের কারণে যেভাবে সমস্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আমাদের দেশেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
জলবায়ু
মৌসুমি বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে বছরের অধিকাংশ সময়ই প্রবাহিত হয়। ফলে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তিত হয়। গ্রীষ্মকালে এদেশে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। এ বায়ু প্রচুর জলীয় বাষ্প বহন করে। ফলে গ্রীষ্মের শেষে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
ঋতুভেদে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ভিন্নতা
আবির্ভূত হয়। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে খাল বিল শুকিয়ে যায়। এ সময় প্রকৃতি বুদ্ৰ বুক্ষ ভয়াল মূর্তি ধারণ করে কালবৈশাখীর ভাঙলীগায় বছরের সঞ্চিত ক্লেদ গ্লানি ও জঞ্জালকে সুদূরে উড়িয়ে নিয়ে যায়। গ্রীষ্মের অবসানে মেঘের পাহাড় নিয়ে ও ঢাক ঢোল কলিয়ে মহাসমারোহে নেমে আসে বর্ষা। আকাশে চলে বজ্র বিদ্যুতের তাণ্ডব নৃত্য। শুরু হয় অবিরাম বারিবর্ষণ। মাঠ ঘাট নদী নালা তলিয়ে যায় অথৈ পানির নিচে। দিকে দিকে নানাবিধ ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে প্রকৃতিকে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলে।বর্ষার অবসানে কাঁচা সোনা রঙ গায়ে মেখে আবির্ভূত হয় সোনালি শরৎ ছড়িয়ে পড়ে রকমারি ফুলের মন মাতানো সৌরভ। শারদ প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য বাঙালির হৃদয়ে বুলিয়ে দেয় প্রশান্তির মৃদু মলয়। হেমন্তের আগমন ঘটে হৈমন্তির ধানের হেমহাসি নিয়ে। প্রকৃতির অঙ্গে অঙ্গে দেখা দেয় যৌবনের পূর্ণ দীপ্তি। শীতকালে প্রকৃতি শুষ্ক শীর্ণ ও বিবর্ণ হয়ে যায়। তরুলতা ও গুল্বরাজি সবুজ পোশাক পরিত্যাগ করে বিধবার সাজ পরে।শীতের অবসানে রূপ বৈচিত্র্যের ডালি হাতে আবির্ভূত হয় ঋতুরাজ বসন্ত। বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে রূপ লাবণ্যের জোয়ার বয়ে হয়। প্রকৃতি নবযৌবন লাভ করে। পত্র পুষ্পে নববধূর সাজে সজ্জিত হয় গোটা বিশ্ব প্রকৃতি। ভ্রমরের গুঞ্জনে কোকিলের কুণ্ডতানে নদীর কূল কূল ধ্বনিতে বসন্তের স্তুতিবাদ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে গোটা বিশ্বকে মুখরিত করে তোলে!
বাংলাদেশের প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যতা
প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্যের রূপ ছড়িয়ে আছে গােটা দেশ জুড়ে। তবে অঞ্চলভেদে বৈচিত্র্যও আছে। শাল মহুয়ার ঘন বীথি ঝিলিমিলি ঝিল আর বিশাল বিল প্রকৃতিকে করেছে ঐশ্বর্যশালী ও লাবণ্যময়। পশ্চিম অঞ্চলের অবারিত প্রান্তর, বালুময় পথঘাটে আছে ধূলিধূসর রুক্ষতা। তবে মাঠের পর মাঠ আখের ক্ষেত আম বাগান ও পানের বরজ আছে। সেখানেও দিগন্ত জুড়ে সবুজ শ্যামলিমা। পূর্বাঞ্চলে নীলাভ পাহাড়ের ঢালে বিছানাে চায়ের বাগানগুলাে যেন সবুজ সিঁড়ির ধাপ দিয়ে সাজানাে। তারই ফাঁকে ফাঁকে ছায়াবীথির বিস্তার। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদীর বুকে ঢলে পড়া সূর্যের আভা রঙের কারুকাজ ফুটিয়ে তােলে। মধুপুর ও ভাওয়াল অঞ্চলের প্রকৃতিতে রয়েছে ভিন্নতর দৃশ্যপট। সেখানে গেরুয়া মাটিতে সারি সারি গজারি গাছের বিস্তার। আর দক্ষিণের উপকূল জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। সেখানে রয়েছে চির সবুজ পাতার টোপর পরা পল্লবঘন তরুবীথি। আর সেখানেই বসতি পেতেছে ডােরাকাটা বাঘ আর চিত্রল হরিণেরা। দক্ষিণের সুনীল সাগরের বুকে ভেসে থাকা দ্বীপাঞ্চলে রয়েছে আর এক ধরনের চিত্র।সেখানে প্রকৃতির দৃশ্যপট তৈরি করেছে তাল নারকেল সুপুরির বাগান। বেত শােলা কেওড়ার বন আর প্রান্তর জোড়া ধানক্ষেত। সেখানে ঘর বেঁধেছে। সংগ্রামে দুর্জয় মানুষেরা। জলােচ্ছ্বাসের মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে তারা বাঁচে আর সমুদ্র শান্ত থাকলে তারা বাঁচে সাগরের সঙ্গে মিতালি করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উপমহাদেশের এ দেশটি তাই মন মাতানাে দৃষ্টিনন্দন এবং কবি লেখক তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। এর সৌন্দর্যে বিভাের হয়ে কবি পেয়েছে ভাষা মানুষ পেয়েছে আশা। পর্যটক চোখ খুলে মন ভরে উপভােগ করে এর সৌন্দর্য মেটায় অন্তরের তৃষ্ণা। এর অনুপম নৈসর্গিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উপভােগের জন্য বাংলাদেশ যুগে যুগে হাতছানি দিয়েছে কাছের ও দূরের ভ্রমণপিপাসুদের। অনেকেই তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় প্রশক্তি গেয়েছেন বাংলাদেশের মনলােভা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের।
বনভূমি ও পাহাড়
পৃথিবীর সবচেয়ে বড়াে ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া এ বন নানা জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নানা বৃক্ষরাজিতে শােভিত গভীর রহস্যে ভরা। পাহাড়িয়া অঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধতর করেছে। এ অঞ্চলটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ সিলেট চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বান্দরবান অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। ময়মনসিংহের মধুপুর ও গাজীপুরের ভাওয়ালের গড় কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের বনাঞ্চল যেন অপার সৌন্দর্যের আধার। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া অঞ্চল গারাে পাহাড়ের পাদদেশ ও সিলেটের সবুজে সবুজে ছাওয়া বিস্তীর্ণ চা বাগানসহ সমগ্র পাহাড়িয়া অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ।
নদ নদী ও হাওর বাঁওড়
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর নদী নালা হাওড় বাওড় খাল বিল সব মিলে৷ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এক বিচিত্র রূপের অপূর্ব সমারােহ। পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্রহ্মপুত্র তিস্তা আড়িয়াল খাঁ কর্নফুলী আর বুড়িগঙ্গা যার বুকে ভেসে থাকা রংবেরঙের পাল তােলা সারিসারি নৌকার অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন রূপ বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও মােহনীয় ও আকর্ষণীয় করে তােলেছে। অপরদিকে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জুড়ে অবস্থিত চলনবিল এবং সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওড়সহ অসংখ্য হাওড় বাওড় এদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বিশিষ্টতা দান করেছে। তাই আজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগুলাে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।
বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল
বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চল পলিগঠিত বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল। উর্বর এ সমভূমি অঞ্চলে দৃষ্টিগােচর হয় সবুজের সমারােহ। সবুজ মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় এ যেন সবুজের বিশাল সমুদ্র। শস্যসম্ভবা সবুজ শ্যমলিমা যখন মৃদুমন্দ বাতাসে আলােড়িত হয় তখন মনে হয় সবুজ উর্মিমালা বুঝিব ধেয়ে যাচ্ছে দিগন্তের পানে।
সংস্কৃতি
হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গড়া এ দেশ। এ দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এর রূপমাধুর্যে যেন একটি স্বতন্ত্র মাত্রা যােগ করেছে। বাংলা বর্ষবরণ ও বসন্তবরণের মতাে অনুষ্ঠানগুলাে আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এগুলাে রঙ রূপ ও বৈচিত্রে সমকালীন প্রকৃতির অনুরূপ। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশে এগুলাে ভিন্ন ও রােমাঞ্চকর আমেজ সৃষ্টি করে। ফলে সুপ্ত মনের পাতায় পাতায় মনের অজান্তেই আমরা এঁকে যাই প্রকৃতির ছবি লিখি কবিতা গেয়ে উঠি গান। মন হারিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়
বাংলাদেশের প্রকৃতি কখনাে কখনাে ধ্বংসাত্মকরূপে আবির্ভূত হয়। গ্রীষ্মের আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ ও বিবর্ণ হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড তাপে হারিয়ে যায়, সবুজ প্রকৃতির অপরূপ শ্যামল শােভা। ফেটে চৌচির হয়ে যায় ফসলের মাঠ শুকিয়ে যায় নদী চারিদিকে কেবল ধু ধু হাহাকার। ভয়াল রুদ্র রূপ নিয়ে হাজির হয় কালবৈশাখি। এটি উড়িয়ে নিয়ে যায় আমাদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলে গাছপালা। প্রচণ্ড গরমে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে। মানুষ তখন চাতক পাখির ন্যায় আকাশ পানে চেয়ে থাকে। বর্ষাকালেও প্রকৃতি মাঝে মাঝে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। বন্যা জলােচ্ছাসের ফলে মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ভােগ করতে হয়। উপকূলবর্তী মানুষের সাথে প্রকৃতি সবসময় বৈরী আচরণ করে। জলােচ্ছাসের সাথে তাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। অতিরিক্ত বন্যায় গবাদি পশুর অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। শীতকালে আমাদের দেশের গরিব মানুষদের দুঃখের সীমা থাকে না। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষদের বেশি শীতের কষ্ট সহ্য করতে হয়। শীতে বৃদ্ধ ও শিশুদের বেশি কষ্ট হয়ে থাকে। নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সময় কাটাতে হয়।
উপসংহার
বাংলার ছায়াঘেরা পল্লী তৃণাচ্ছাদিত মাঠঘাট আম জাম কাঁঠালের কুঞ্জবন তাল নারকেল সুপারি বৃক্ষের সারি পুকুর দীঘি জলাশয় ইত্যাদি এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে। কবির ভাষায়
অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে পদধূলি ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি
পল্লবঘন আম্র কানন রাখালের খেলাগেহ স্তব্ধ অতল দীঘি কালোজল নিশীথশীতল স্নেহ।
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব। পৃথিবীর কোন দেশের সাথে এর সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।
আরো দেখুন (প্রবন্ধ রচনা) :