ছাত্রজীবন মধুর জীবন, যদি না থেকে পরীক্ষা! পরীক্ষা নামক দানব ছাত্রজীবনে তাড়া করে বেড়ায় দিনরাত্রি। ক্লাস পরীক্ষা, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, মাসিক পরীক্ষা, হঠাৎ পরীক্ষা, ষাণ্মাসিক পরীক্ষা, টিউটোরিয়াল পরীক্ষা, প্রস্ততি পরীক্ষা, অর্ধ বাৎসরিক পরীক্ষা, বাৎসরিক পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা অবশেষে চাকরির পরীক্ষা- পরীক্ষার যেন অভাব নেই! কিভাবে সূচনা হলো সেই পরীক্ষা পদ্ধতি, জেনে নিন আমাদের এ আয়োজনে।
যেভাবে পরীক্ষা পদ্ধতি
Examination এর বাংলা অর্থ পরীক্ষা। পরীক্ষা সংস্কৃত ভাষার শব্দ। পরীক্ষা কে আবিষ্কার করে, সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে বলা যায়, পরীক্ষা পদ্ধতির শুরু আসলে সভ্যতার গোড়ার দিকেই। চীনারাই এটি প্রথম শুরু করেন। ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে সুই রাজবংশের রাজারা সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য Standardized Test বা সার্বভৌম পরীক্ষা শুরু করেন। এরপর কুইং সাম্রাজ্যের শাসনামলে এই পরীক্ষা পদ্ধতি স্থগিত করা হয়। তবে Examination শব্দটির উৎপত্তি কিন্তু চীনে হয়নি। লাতিন শব্দ ‘এক্সামিনেশনেম’কে গ্রহণ করে ফরাসিরা। তারা উচ্চারণ করত Examinacion। সেখান থেকে নানা পথ ঘুরে পুনরায় ইউরোপে গিয়ে নাম ধারণ করে Examination। নানা পথ ঘুরে মানে ফ্রান্স থেকে জার্মানি, জার্মানি থেকে ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। তারা চীনা সভ্যতার সেই পুরোনো পরীক্ষা পদ্ধতিকে নতুনভাবে সাজায়। ১৮০৬ সালে ইংল্যান্ডে শাসকরা তাদের রাজ্যের বেসামরিক পদে লোকবল নিয়োগের জন্য অনেকটা চীনের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে। এক সময় পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পরীক্ষা পদ্ধতি। ১৮৫৮ সালে উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা চালু হয়। তবে ইতিহাস এ কথাও জানান দেয় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসারও বহু আগে থেকে ভারতীও উপমহাদেশে শিক্ষার সূচনা হয়েছে। সেই ৪২৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ভুবন বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুরুর দিকে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল বলে জানা যায় না। পরীক্ষার ফল নয়, বরং জ্ঞানার্জনকেই সবচেয়ে বড় পুরস্কার বলে মনে করত তারা।
আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতি
আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতির জনক মনে করা হয় হেনরি ফিশেলকে। তিনি শিক্ষকতা করতেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে। একদিন তার মনে হলো, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে যেকোনো ঘটনা বা ব্যক্তিকে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা দরকার। আর এ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দরকার একটি সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতি। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে তিনি পরীক্ষা নেওয়ার একটা পদ্ধতি তৈরি করেন।
সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি
শিক্ষা মানেই আচরণের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রফেসর বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম ও তার কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে ১৯৫৬ সালে Taxonomy of Educational Objectives নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। উক্ত গ্রন্থে শিখনের অন্যান্য আলাদা ক্ষেত্র হিসেবে পরীক্ষাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্লুমের মতে একটি বিষয়বস্ত থেকে শিক্ষার্থী শুধু জ্ঞানই অর্জন করে না বরং ঐ জ্ঞান সংশ্লিষ্ট আরও অনেক দক্ষতা অর্জন করে থাকে। ব্লুম শিখনের ক্ষেত্রকে প্রধান ৩ ভাগে বিভক্ত করেন। যেমন- বুদ্ধিবৃত্তিক বা জ্ঞানমূলক ক্ষেত্র, আবেগিক ক্ষেত্র এবং ক্ষেত্র। আর উচ্চতর চিন্তার তিনটি স্তর হলো ‘বিশ্লেষণ’, ‘সংশ্লেষণ’, ও ‘মূল্যায়ন’। বেঞ্জামিন মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করার আশায় চালু করেন ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি। যদিও এ সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির জন্য একক ব্যক্তিকে প্রবর্তক বলা যায় না। তবুও তাকেই এ সৃজনশীলের জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার চিন্তার কাঠামো শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তখনই যখন ২০০১ সালে ব্লুমের ছাত্র লরিন এন্ডারসনের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ একে ঢেলে সাজান।
কিভাবে এলো ৩৩ নম্বরের পাস
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদের ৩৩ নম্বর পেলেই পরীক্ষায় পাস বলে ধরা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিটা কিভাবে এলো, তা হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। ১৮৫৮ সালে উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা চালু করা হয়। কিন্তু পাস নম্বর কত হবে তা নিয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়েন। তাই ব্রিটেনে কনসাল্টেশনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়। তখন ব্রিটেনে স্থানীয় ছাত্রদের জন্য পাশের নম্বর ছিল ৬৫। সে সময় ইংরেজ সমাজে একটা প্রচলিত ধারণা ছিল The people of Subcontinent are half as intellectual and efficient as compared to the British অর্থাৎ ‘বুদ্ধি ও দক্ষতায় উপমহাদেশের মানুষ কে ইংরেজদের তুলনায় অর্ধেক বলে মনে করা হতো’। এরই ধারাবাহিকতায় মেট্রিকুলেশনের পাস নম্বর ৬৫ এর অর্ধেক ৩২.৫ নির্ধারণ করা হয়। ১৮৫৮-১৫৬১ সাল পর্যন্ত পাস নম্বর ৩২.৫ ছিল। ১৮৬২ সালে তা গণনার সুবিধার্থে বৃদ্ধি করে ৩৩ করা হয়। সেই থেকে এই ৩৩ নম্বরই চলছে। তবে অনেক সময় ৩২ পেলেও পাস করিয়ে দেওয়া হয়।
1 Comment
Really good