আধুনিক বিশ্বে যতরকম মেলা হয়ে থাকে এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বইমেলা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ মেলার আয়োজন করা হয়। ‘বইমেলা’ শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির প্রাণের আবেগ। ‘বইমেলা’ শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘অমর একুশে বইমেলা’। লাখো নতুন বইয়ের সমারহ, লেখক-পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে ‘অমর একুশে বইমেলা’র গুরুত্ব অপরিসীম।
বইমেলার উৎপত্তি
খ্রিষ্টীয় পরেনো শতকে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার করেন। বলা হয় সেই সময় থেকেই বইমেলার সূচনা হয় জার্মানিতে। অনেকের মতে জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলা হয়। তবে কেউ কেউ মনে করেন, বইমেলা প্রথম শুরু হয় ফ্রাঙ্কফুর্টে, কিন্তু লিপজিগে খুব বড় করে মেলার আয়োজন হওয়ায় ওটার নামই লকজন জানত বেশি। সে সময় বইমেলাগুলো তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ শতকের পর ইউরোপসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে বইমেলা শুরু হয়।
বাংলাদেশে বইমেলা
বাংলাদেশে বইমেলার চিন্তাটি প্রথমে মাথায় আসে কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীনের। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে গ্রন্থকেন্দ্রে পরিচালক পদে নিয়োগ পান। তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই সংগ্রহ করত। এর মধ্যে একটি বই ছিল Wonderful World of Books। এই বইটি পড়তে গিয়ে তিনি হঠাৎ দুটি শব্দ দেখে পুলকিত বোধ করেন। শব্দ দুটি হলো- Book এবং Fair। কত কিছুর মেলা হয়। কিন্তু বইয়েরও যে মেলা হতে পারে এবং বইয়ের প্রচার-প্রসারের কাজে এই বইমেলা কতটা প্রয়োজনীয়, সেটি তিনি এই বই পড়েই বুঝতে পারেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ১৯৬৫ সালে তিনি তৎকালীন সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরিতে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) একটি শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকে বাংলাদেশে গ্রন্থমেলার সূচনা। শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করে সরদার জয়েনউদদীন পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেননি। এরপর তিনি ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন।
অমর একুশে বইমেলা
ইউনেস্কো ১৯৭২ সালকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে সরদার জয়েনউদদীন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা। কিন্তু এই সালে বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। তাকে অনুসরণ করে মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও সেভাবেই তাদের বই নিয়ে বসে যান। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ বাংলা একাডেমির উদ্যোগে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেন। এই মেলায় নিজামী, চিত্তবাবু এবং তাজুল ইসলামসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান। ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য কিছুটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সেই নির্দিষ্ট স্থানে প্রকাশকরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। তার নিজ উদ্যোগে বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ৭-২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলার নামকরণ করে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের করে এবং মেলার উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলা একাডেমি সে মেলার আয়োজন করে। ১৯৮২ সালের মেলায় সহযোগী হিসেবে ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ঐ মর্মান্তিক ঘটনার পর সে বছর আর বইমেলার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি আবার ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন করে। ১৯৮৩ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র পরিবর্তে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামকরণ করলেও ১৯৮৪ সালে তা কার্যকর করে বাংলা একাডেমি। ২০১৪ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় স্টলের সংখ্যা বাড়িয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করে। বর্তমান এ মেলা ‘অমর একুশে বইমেলা’ নামেই পরিচিত।